রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • কলকাতা
দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
‘ময়দানের সন্ন্যাসী’।
পুরোদস্তুর ‘ক্রিকেটার’।
বাংলার সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ।
যাঁর নামের পাশে আজ এমন বহু বিশেষণের ভিড়, তিনি আর নেই। দীর্ঘ রোগভোগের পর চলে গেলেন লেসলি ক্লডিয়াস। পঁচাশি বছর বয়সে।
মেলবোর্ন থেকে ময়নাগুড়ির আড্ডায় নাসার বিজ্ঞানীদের তত্ত্ব উড়িয়ে যখন শুক্রবারের পৃথিবী ধ্বংস নিয়ে তুমুল আলোচনা, তখন হকির পৃথিবী আচমকা ‘পিতৃহীন’। অশোক কুমার, জাফর ইকবালরা বলছেন, “ভারতীয় হকির গৌরবময় এক অধ্যায়ের আজ মৃত্যু হল।”
কিন্তু এত সহজে ক্লডিয়াস-অধ্যায়ের মৃত্যু কখনও হতে পারে? সম্ভব? |
ডাক্তারি রিপোর্টে তিনি অতীত। কিন্তু ময়দানে অমর। এত স্মৃতি, গর্বের এমন ইতিহাস, কী ভাবে ভুলবে ময়দান? কী ভাবে ভুলবে, নিয়মানুবর্তিতা, সততা, নির্লোভ ব্যক্তিত্বের ক্লডিয়াসকে?
দক্ষিণ কলকাতার নার্সিংহোম চত্ত্বরে সন্ধেয় তারই তো স্মৃতিচারণ চলছিল। গুরবক্স সিংহের আজও মনে পড়ে ’৬৪-র সে দিন। যে দিন মোহনবাগান মাঠে শুধু তাঁকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে এসেছিলেন ক্লডিয়াস। জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “অধিনায়ক হিসেবে আমি যা পারিনি, তুমি তা করলে। আবার সোনা আনলে।” জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল ক্লডিয়াসের। চুনী গোস্বামী বলছিলেন, “দেখা হলেই বলতেন, আমার সব হল, অলিম্পিকে অধিনায়ক হিসেবে দেশকে শুধু সোনাটাই দিতে পারলাম না।” শুনলে কে বলবে, চার-চারটে অলিম্পিক পদক তাঁর বাড়িতে। ’৪৮ থেকে ’৬০এই সময়ের মধ্যে। তিনটে সোনা, একটা রুপো।
যদিও আজ একটাও নেই। চুরি হয়ে গিয়েছে!
ক্লডিয়াসের সঙ্গে কথা কথায় যা জানতে পেরেছিলেন প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ক রাজু মুখোপাধ্যায়। “একবার ওঁর ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছি। তখনই বলেছিলেন, কে যেন পদক পালিশ করতে এসে ওগুলো নিয়ে চলে গেল,” বলছিলেন রাজু। যাঁর কাছে ক্লডিয়াস ‘ময়দানের সন্ন্যাসী’। কেন? “কোনও দিন প্রচার, অর্থ, যশ কিছুই তো চাইলেন না উনি! এমন নির্লোভ মানুষ দেখা যায় না।”
ঘটনা। নইলে আর বিদেশে কোচিংয়ের প্রস্তাব ফেরানো যায়? জাত্যাভিমান ক্লডিয়াসের এতটাই ছিল যে, দেশের বিরুদ্ধে কোনও দিন স্ট্র্যাটেজি ছকতে বসবেন, ভাবতেই পারতেন না। “এক-এক সময় তো ওঁকে দেখে আমার ক্রিকেটার মনে হত। ক্রিকেট বলতে যা বোঝায়, ওঁর জীবনের সংজ্ঞাটাও সে রকমই। স্বচ্ছ্ব। পরিষ্কার,” বলে দিচ্ছেন আর এক প্রাক্তন বাংলা অধিনায়ক গোপাল বসু। আর নাগপুরে কমেন্ট্রিবক্সে ঢোকার মুখে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য, “ক্লডিয়াস কিংবদন্তি। বাংলার সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ।” |
আর সর্বকালের সেরা বঙ্গ-ক্রীড়াবিদকে হারানোর যন্ত্রণাটা বোঝা যায় পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝরঝরিয়ে কান্না দেখলে। দীর্ঘ দিনের বন্ধু কেশব দত্তের বিলাপ শুনলে। “সকালেও কাগজে পড়লাম একটু সুস্থ। আমার কত দিনের বন্ধু... চলে গেল।” পিকে-র গলা অবরুদ্ধ। কথা আটকে যাচ্ছে কান্নায়। হাসপাতালে দাঁড়িয়ে অসুস্থ শরীরে কোনও মতে বলছিলেন, “ষাটের রোম অলিম্পিকের সময় পোপ ক্লডিয়াসকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আশির্বাদ করতে। কত বড় সম্মান ভাবা যায়! বাংলার শুধু নয়, ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ আজ চলে গেল। তেমন কোনও সম্মানই না পেয়ে।” প্রাক্তন জাতীয় টেনিস তারকা জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের মুখেও কথা সরছে না। “একটা অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে ধরছে। কত দেখা হয়েছে কাস্টমস মাঠে।”
বৃহস্পতিবারের পর থেকে সেই কাস্টমস মাঠ থাকবে। থাকবে হকি স্টিক হাতে কিঁচকাঁচার দৌড়োদৌড়ি।
হৃদয়ে লেসলি ওয়াল্টার ক্লডিয়াস হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে! |