ব্র্যাডম্যান ক্রিকেটে যা, হকিতে তেমনই ধ্যানচাঁদ। চ্যাম্পিয়ন অব চ্যাম্পিয়ন্স। সেই ধ্যানচাঁদ লেসলি ক্লডিয়াসের নাম দিয়েছিলেন ‘হকির চড়ুইপাখি’। গোটা মাঠে যখন যেখানে বল, চড়ুইয়ের মতো ফুরুৎ-ফুরুৎ করে সেখানে যেন উড়ে পৌঁছে যেতেন ক্লডিয়াস। হকির যাদুকর যখন ভারতীয় দলের নির্বাচকপ্রধান, বলেছিলেন, “জাতীয় দলে ক্লডিয়াস নিজেই নিজেকে নির্বাচিত করেছে। আমাকে এ বার বাকি দলটা বাছতে হবে।”
খুব ছোটবেলায় বিলাসপুরে মামাবাড়ি থেকে কলকাতায় এসেছিলেন ক্লডিয়াস। সেই থেকে এ শহরে কাটিয়ে ৮৫ বছরে চিরতরে চলে গেলেন। খড়গপুরে এখন যেখানে সেরসা স্টেডিয়াম, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির উত্থানের আঁতুরঘর যেটা, সেই মাঠেই অদ্ভুত ভাবে ক্লডিয়াসের হকি প্লেয়ার হয়ে ওঠা! তখন জাতীয় হকিতে বেঙ্গল নাগপুর রেলের দু’টো দল খেলত। সেই দুটো দলের মধ্যে একদিন প্র্যাক্টিস ম্যাচ চলছে। ছত্রিশ অলিম্পিকে ভারতীয় হকি দলের দুই তারকা জো গ্যালিবার্ডি আর ডিকি কার খেলছেন। মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে দেখছেন ক্লডিয়াস। তিনি তখন ফুটবলটা চুটিয়ে খেলেন। হঠাৎ একজন তাঁকে বলেন, “আমাদের টিমে একজন প্লেয়ার কম পড়েছে। তুমি একটু খেলে দেবে?” হকি স্টিক হাতে ক্লডিয়াসের সেই ‘একটু খেলা’ দেখে সে দিন গ্যালিবার্ডি-কার সমস্বরে বলেছিলেন, “ভাই, এখনই ফুটবলটা ছেড়ে শুধু হকি খেলো। হকিটাই তোমার খেলা।”
যে খেলায় অলিম্পিকে বিশ্বের প্রথম প্লেয়ার হিসেবে তিনটে সোনা আর একটা রুপোর পদক জেতেন ক্লডিয়াস। টানা চারটে অলিম্পিক হকি থেকে ক্লডিয়াসের পদক জেতাটা আজও বিশ্বরেকর্ড। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডেও যার উল্লেখ আছে। ভারতীয় হকির পতনের যদি অন্যতম কারণ হয়ে থাকে, এ দেশের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের এই খেলাটা থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা, তা হলে পাশাপাশি এটাও নিশ্চিন্তে বলা যায়, ওই সম্প্রদায়ের সর্বকালের সেরা হকি প্লেয়ারের নাম লেসলি ওয়াল্টার ক্লডিয়াস। গত ষাট বছরে হকি দুনিয়ায় ক্লডিয়াসের মতো কেউ আসেননি। আগামী তিরিশ বছরেও হকির আকাশে ক্লডিয়াসের মতো কাউকে দেখা যাবে কি না সন্দেহ।
ষাটের অলিম্পিক অধিনায়ক। একাত্তরে পদ্মশ্রী। চুয়াত্তর ও আটাত্তর এশিয়াডে ভারতের হকি ম্যানেজার। কিছু সময়ের জন্য জাতীয় নির্বাচক এগুলো ক্লডিয়াসের মাপের প্লেয়ারের পক্ষে কোনও সম্মানই নয়। বেঙ্গালুরুতে অনিল কুম্বলে সার্কেল-এর মতো এবং তার অনেক আগেই কলকাতার কোনও রাস্তার নাম ‘লেসলি ক্লডিয়াস সার্কেল’ হলে হয়তো ন্যায্য হত। ভিয়েনায় চার হাতে চারটে হকি স্টিক ধরা ধ্যানচাঁদের আবক্ষমূর্তির মতোই ভারতে ক্লডিয়াসের মূর্তি বসলেও বোধহয় ঠিক হত। যে মানুষটা কাস্টমস-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর হিসেবে অবসর নেওয়া সত্ত্বেও এ শহরের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়ায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভাড়াবাড়িতে কাটালেন, তাঁকে মরণোত্তর যত সম্মানই এখন দেওয়া হোক না কেন, তাতে লেসলি ক্লডিয়াসের সঠিক মূল্যায়ন বোধহয় কোনও দিনও হবে না। |