|
|
|
|
পথ দেখাচ্ছে গুজরাত, বিমুখ বাংলা |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি |
এ হল উন্নয়নের জয়। গুজরাতের রাজ্যপাটে তৃতীয় বারের জন্য আসীন হয়েই বললেন নরেন্দ্র মোদী। বিজেপি ক্ষমতায় এল নাগাড়ে পাঁচ বার।
দশ বছর আগে যখন মোদী প্রথম বার জেতেন, রাজনীতির কারবারিরা বলেছিলেন, এ জয় গোধরার দাক্ষিণ্যে। পাঁচ বছর আগে তাঁদের বিশ্লেষণ ছিল, সনিয়া গাঁধীর ‘মওত কা সওদাগর’ মন্তব্যই তাতিয়েছে গুজরাতবাসীকে। এ বার না ছিল গোধরা, না কংগ্রেসের সেই কটাক্ষ। তবু ক্ষমতায় থাকার কুফল (অ্যান্টি ইনকামব্যান্সি ফ্যাক্টর) তুচ্ছ করে মোদী জিতলেন উন্নয়ন আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহসের জোরেই।
আর এখানেই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে গুজরাতের ফারাক দেখছেন বিশ্লেষকেরা। বলছেন, গুজরাত উন্নয়ন চায়, তাই পায়। পশ্চিমবঙ্গ উন্নয়ন চায় না, তাই পায়ও না। এই বিশ্লেষকদের যুক্তি, আড়াই দশক ধরে এ রাজ্যে কার্যত কোনও উন্নয়নই করেননি জ্যোতি বসু। বিদেশি ব্যাঙ্ক কম্পিউটার বসাতে চাইলে তাঁর দলের শ্রমিক সংগঠন বাধা দিয়েছে। জ্যোতিবাবু দলের মুখ চেয়ে নীরবই থেকেছেন। দলের কট্টরপন্থীদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে সংস্কারের পথে হাঁটার ইচ্ছা বা সাহস, কোনওটাই দেখাননি তিনি।
সাহস দেখালেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রকাশ কারাটদের বাধ্য করলেন তাঁর শিল্পায়নের নীতি মেনে নিতে। বললেন, “এমন একটা দলে আছি, দুর্ভাগ্যবশত যারা বন্ধ করে। কিন্তু আর সহ্য করব না।” টাটাদের ডেকে আনলেন রাজ্যে। গাড়ি শিল্পে নয়া দিগন্ত খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে। রাজ্যকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা।
কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টায় দৃঢ়তার অভাব ছিল বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দাশগুপ্ত। তাঁর কথায়, “বুদ্ধবাবুর জায়গায় যদি মোদী থাকতেন, তা হলে তিনি অনেক কঠোর ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেন। সিঙ্গুরে আন্দোলন হতে দিতেন না। যে কারখানার আশি শতাংশ হয়ে গিয়েছিল, সেখানে তিনি কাজ শুরু করতেনই।” এই ভয় না-পেয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মানসিকতাই মোদীর সাফল্যের চাবিকাঠি বলে মত দীপঙ্করবাবুর।
স্থিতাবস্থা আঁকড়ে জ্যোতিবাবু কখনও হারেননি। এগোনোর চেষ্টা করে বুদ্ধবাবু হারলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, তাঁর বদলে যিনি এলেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ের তলার জমি কিন্তু গড়ে দিয়েছিল সিঙ্গুরে ন্যানো-বিরোধী আন্দোলন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে শিল্পের জন্য এক ছটাকও জমি অধিগ্রহণ করবেন না। শিল্পমহল প্রমাদ গুনলেও মমতাতেই মজেছিল বাংলার মন।
অন্য দিকে মোদী কী করলেন? গোটা নির্বাচনটাই তিনি লড়লেন শুধু উন্নয়নের জোরে। হিন্দুত্বের পোস্টার বয় ‘রাম’কে ছেড়ে হাতিয়ার করলেন ‘বিজলি-পানি-সড়ক’। শোনালেন তাঁর আমলে উন্নয়নের খতিয়ান। দেখালেন আগামী দিনে আরও উন্নয়নের স্বপ্ন। এমনকী, দলের নির্দেশ মেনে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির (এফডিআই) মৌখিক বিরোধিতা
করলেও মোদীর মন কিন্তু বিদেশি লগ্নির পক্ষেই। তাই কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী আনন্দ শর্মা যখন এফডিআই নিয়ে রাজ্যগুলির মত চেয়ে চিঠি দেন, তখন জবাব দেননি মোদী। আজ যুদ্ধ জিতে তৃপ্ত মোদীর মন্তব্য, “বাস্তবে যদি উন্নয়ন করে দেখানো যায়, মানুষ যদি তার সুফল পান, তা হলে ভোটবাক্সেও তার প্রতিফলন ঘটে।”
কংগ্রেস স্বাভাবিক ভাবেই মোদীকে কৃতিত্ব দিতে নারাজ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কপিল সিব্বলের দাবি, “গুজরাতের মানুষ বরাবরই উন্নয়নমুখী। আবহমান কাল ধরেই তাঁদের মধ্যে এই মানসিকতা রয়েছে। ফলে মোদীর তেমন কৃতিত্ব নেই। মোদী যত না উন্নয়ন করেন, তার থেকে বেশি ঢাক পেটান।” বিজেপি নেতাদের পাল্টা বক্তব্য, রাজ্যের মানুষের উন্নয়নমুখী মানসিকতাকে সঠিক পথে চালিত করেছেন মোদীই। দক্ষ প্রশাসনের মাধ্যমে। শিল্পের অনুকূল পরিবেশ করেছে। শিল্প সংস্থাকে সহজে জমি দেন, কর ছাড় দেন, পরিকাঠামো দেন। তাই দেশি-বিদেশি সংস্থা ভিড় করেন গুজরাতে। টাটা-অম্বানী থেকে ছোট-মাঝারি শিল্পপতি, সবার গন্তব্য গুজরাত।
আর উন্নয়নের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুফল পান আম-গুজরাতিই। চব্বিশ ঘণ্টা আলো, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, জল। উন্নয়নের প্রদীপের তলাতেই অন্ধকার বলে ভোট বাজারে প্রচার করেছেন মোদী-বিরোধীরা। উঠছে ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়ার অভিযোগও। সৌরাষ্ট্রের বহু এলাকায় জল-বিদ্যুতের অভাবকে অস্ত্র করার চেষ্টা করেন কেশুভাই পটেল। জবাবে মোদী আশ্বাস দিয়েছেন, সেখানেও শীঘ্রই পৌঁছবে সব সুবিধা। তিন বছরের রোডম্যাপ তৈরি তাঁর ঝুলিতে। মোদীকে বিশ্বাস করেছেন গুজরাতের মানুষ। বিজেপি নেতা অরুণ জেটলির কথায়, “নরেন্দ্র মোদী উন্নয়নমুখী মুখ্যমন্ত্রী। দিনে একুশ ঘণ্টাই তিনি কাজ করেন। ভাবেন রাজ্যের আরও কী করে উন্নয়ন হবে। তাঁর সেই গুজরাত মডেল নিয়েই এ বার দেশে প্রচার করবে বিজেপি। কারণ, কেন্দ্র বা কোনও রাজ্যের পক্ষেই আজ আর উন্নয়নকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।” বিজেপি-রই এক নেতার বক্তব্য, জাতপাতের সমীকরণ যতই থাক, বিহারে নীতীশ কুমার কিন্তু মূলত উন্নয়নে সওয়ার হয়েই দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসেছেন। রাজ্যের উন্নয়নই এখন তাঁর মূল স্লোগান।
প্রশ্ন মনমোহন সিংহও তো সংস্কারের পথেই এগোতে চাইছেন। তার বিরোধিতা করছে কেন বিজেপি? কাজটা যে ঠিক হয়নি, সেটা গুজরাত-হিমাচল প্রদেশের ভোটের পর বোঝা যাচ্ছে বলেই বিজেপি-র বহু নেতার মত। ভোটের আগে দলের শীর্ষ নেতাদের ধারণা ছিল, গোটা দেশে কংগ্রেসের সংস্কার রাজনীতির বিরোধী হাওয়া বইছে। কিন্তু হিমাচল সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। গুজরাতেও জয় সেই সংস্কারের পুঁজিতেই।
২০১৪-এ তবে কি উন্নয়নের অস্ত্র নিয়ে মোদী-মনমোহনের লড়াই? |
|
|
|
|
|