পেটের টানে ভিন্ রাজ্যে কাজের খোঁজে গিয়েছিল দশ বছরের একরত্তি ছেলেটি। বাড়ির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সে। দীর্ঘ চোদ্দো বছর পরে সপ্তাহ দুয়েক আগে হঠাৎ বাড়ির জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে তার। পরিজনদের টানে বুধবার সকালে বর্ধমানের মঙ্গলকোটের খুরতুবা গ্রামে নিজের বাড়ি ফিরল হাসিবুল শেখ।
খুরতুবা গ্রামের কাশেম শেখ ও ফিরোজা বিবির একমাত্র সন্তান হাসিবুল। কাশেম শেখ দিনমজুরি করে সংসার চালান। মাদ্রাসার প্রাথমিক পাঠ শেষ করেই এমব্রয়ডারি কাজ শিখতে মুম্বই পাড়ি দেয় হাসিবুল। শেখ হায়দার আলি নামে গ্রামেরই এক বাসিন্দা তাকে মুম্বইয়ের উল্লাসনগরে একটি কারখানায় নিয়ে যান। রবিউল বাদশা নামে আর এক জনও তাঁদের সঙ্গে মুম্বই গিয়েছিলেন। তিনি যদিও ফিরে এসেছিলেন আগেই। বৃহস্পতিবার রবিউল বলেন, “সে দিন ছিল রবিবার। আমরা কাজ শিখতে গিয়েছিলাম। কাজের জন্য আমাকে বাইরে যেতে হয়েছিল। ফিরে দেখি, হাসিবুল নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তার দেখা মেলেনি।”
হাসিবুল আর এখন বালক নয়, যুবক হয়ে গিয়েছেন এখন। বললেন, “এমব্রয়ডারি কাজ করতে আমার ভাল লাগছিল না। তাই পালিয়েছিলাম।” তিনি জানান, মুম্বইয়ের উল্লাসনগর থেকে হাসিবুল ভাটনগর ও আন্ধেরি যান। |
মায়ের সঙ্গে হাসিবুল শেখ। —নিজস্ব চিত্র। |
ওই দুই জায়গায় হোটেলে কাজ করতেন। তার পরে কেরলে গিয়ে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। হাসিবুলের কথায়, “এর পরে ফের মুম্বইয়ের উল্লাসনগরে ফিরে আসি। সেখানে পরিচিতদের কাউকে দেখতে না পেয়ে দিল্লি চলে যাই।”
দিল্লির ছোটরাম কলোনিতে থাকতে শুরু করেন হাসিবুল। সেখানে এক ঠিকাদার গোষ্ঠীর কাছে রং মিস্ত্রির কাজ করতেন। তাঁর কথায়, “প্রথম দিকে বাড়ির কথা মনে পড়ত। তখন ভাবতাম, একটু পয়সা হলে বাড়ি ফিরব। তার পরে হঠাৎ এক দিন বাড়ির কথা ভুলেই গেলাম। কিছুই মনে ছিল না।” দু’সপ্তাহ আগে হঠাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ে তাঁর। গত রবিবার রাতে ট্রেনে চেপে মঙ্গলবার গভীর রাতে বর্ধমান স্টেশনে এসে পৌঁছন। সেখানে তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ধরে সোজা খুরতুবা মোড়ে নামেন।
হাসিবুল বললেন, “বাস থেকে নামার পরে অনেক চেনা মুখ দেখছিলাম। কিন্তু আমাকে কেউই চিনতে পারেননি। একটি চায়ের দোকানের সামনে দাদুকে দেখেই জড়িয়ে ধরি।” হাসিবুলের দাদু সাবেদ শেখ বলেন, “আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, এ তো আমাদের হাসি। ওকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে আসি।” এত দিন পর ছেলেকে দেখে হকচকিয়ে যান বাবা কাশেম শেখ।
এ দিকে চোদ্দো বছর আগের সেই ছোট্ট হাসিবুলকে দেখতে গ্রামের সকলে ভিড় জমাতে থাকেন। গ্রামের বাসিন্দা মোবেশ্বর হোসেন বলেন, “কাশেম আমাদের বাড়িতেই কাজ করেন। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য কাশেম আর ওর স্ত্রী কী না করেছে! অথচ আজ সে নিজেই ফিরে এল।”
ছেলেকে ফিরে পেয়ে মা ফিরোজা বিবির চোখে তখন খুশির জল। বললেন, “আমি দেখেই বুঝেছিলাম, ও আমার হাসি। পেটের টানে ছেলেকে ছেড়ে কত ভুল করেছি। খেতে না পেলেও আর ওকে কোথাও যেতে দেব না।” |