রাস্তার কুকুরের কামড়ে বিধায়ক-অভিনেত্রী ও পশুপ্রেমী দেবশ্রী রায় জখম হওয়ার পরে নেড়িদের বাড়বাড়ন্ত রুখতে নড়েচড়ে বসেছে পুরসভা। ল্যাপারোস্কোপি পদ্ধতিতে পুরুষ কুকুরদের বেশি সংখ্যায় নির্বীজকরণ করানোর যন্ত্র দেখতে তাই সম্প্রতি চেন্নাইয়ে ছুটেছিলেন কলকাতা পুরসভার কর্তারা।
কিন্তু প্রশ্ন, পথ-কুকুরের নির্বীজকরণে হঠাৎ যন্ত্র দিয়ে অস্ত্রোপচার এত জরুরি হল কেন?
২০০৯ সাল থেকে কলকাতার পথ-কুকুরদের নির্বীজকরণের দায় সামলাচ্ছিল পাঁচটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। নির্বীজকরণ খরচ বাবদ সংগঠনগুলির পুরসভার কাছে প্রাপ্য কুকুর-পিছু ৪৪৫ টাকা। তাদের দাবি, গত পাঁচ মাস ধরেই সেই প্রাপ্য মিলছে না। ফলে, থমকে গিয়েছে কর্মসূচি। |
শহরের পথে কুকুর ধরা। —ফাইল চিত্র |
পুরসভা সূত্রে খবর, বাম আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড’ (এডব্লিউবিআই) এবং কলকাতা পুরসভার মধ্যে ‘অ্যানিমাল বার্থ কন্ট্রোল’ (এবিসি) সংক্রান্ত একটি মউ স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে, নির্বীজকরণের ৪৪৫ টাকার অর্ধেক দেওয়ার কথা পুরসভার। বাকি অর্ধেক দেবে ওই কেন্দ্রীয় সংস্থা। অস্ত্রোপচারের পরে ওভারি, ইউটেরাস এবং টেস্টিস সংরক্ষণের দায়িত্ব ওই সংগঠনগুলির। মাসান্তে এডব্লিউবিআই, স্টেট অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড এবং পুর প্রতিনিধিরা ওই সংরক্ষিত অঙ্গের সংখ্যা গুনে (পুর পরিভাষায় অর্গান কাউন্ট) সংগঠনগুলির হাতে তাদের পাওনা তুলে দিতেন। গত তিন বছর ধরে এটাই ছিল চালু নিয়ম। কিন্তু ‘অর্গান কাউন্ট’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত পাঁচ মাস ধরে সংগঠনগুলি আর টাকাই পাচ্ছে না।
নির্বীজকরণ প্রকল্পের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার সুস্মিতা রায়ের দাবি, “কলকাতার ৯৫টি ওয়ার্ডের নির্বীজকরণের দায়িত্ব ছিল আমাদের। কিন্তু ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের পর থেকে আমরা টাকাই পাইনি। পুরসভার কাছে পাওনা ৪.৬৭ লক্ষ টাকা।” নিয়মানুসারে, প্রতি মাসে পুর কর্তৃপক্ষ ২৫ শতাংশ টাকা অগ্রিম দেবেন। বাকি টাকা, মাস শেষে ‘অর্গান কাউন্ট’-এর পরে। কিন্তু গত পাঁচ মাস ধরে ‘অর্গান কাউন্ট’ করতে প্রতিনিধিরা আসছেন না। টাকাও মিলছে না। অন্য একটি সংগঠনের তরফে সুকন্যা দে বলেন, “মাস পাঁচেক ধরে বরাদ্দ বন্ধ। অস্ত্রোপচারের পরে অঙ্গগুলি সংরক্ষণের দায় আমাদের। কিন্তু কত করব? সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
সংখ্যা-গুনতির সরকারি প্রতিনিধি গৌতমপ্রসাদ সরখেলের (স্বাস্থ্য) অবশ্য দাবি, সংগঠনগুলিকে নিয়মিত টাকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ‘অর্গান কাউন্ট’ না করে কী ভাবে তাদের পাওনা মেটানো হচ্ছে? পুর কর্তৃপক্ষ সদুত্তর দেননি। অতীনবাবুর দাবি, “বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও এবিসি প্রকল্পকে তারা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে দিতে পারেনি। বৃহস্পতিবার থেকে তাই আপাতত পুরসভাই ওই কাজ করবে।”
পুরসভার এক পদস্থ কর্তা অবশ্য মেনে নিয়েছেন, “পুরসভার টাকা নেই। তাই গত অগস্ট মাস থেকে ‘অর্গান কাউন্ট’ এড়িয়ে যেতে হয়েছে। এডব্লিউবিআই-এর কাছে হিসেব না পাঠানোয় তারাও টাকা দিচ্ছে না।” এডব্লিউবিআই-এর সহ-সচিব এস বিনোদকুমার জানান, গত কয়েক মাস ধরে কলকাতা পুরসভা নির্বীজকরণের হিসেব দিচ্ছে না। তাই টাকাও পাঠানো যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে অনেকের প্রশ্ন, “ল্যাপারোস্কোপি যন্ত্র কিনে পুরসভা নির্বীজকরণ কর্মসূচির ‘ব্যর্থতা’ আড়াল করতে চাইছে না তো?” পুর-কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ কথা মানেননি।
চেন্নাই থেকে কলকাতায় ফিরে মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বলেন, “ল্যাপারোস্কোপির ব্যবহারিক দিকটা আমরা আগেই জেনেছিলাম। চেন্নাইয়ে গিয়ে হাতে-কলমে তার ব্যবহার দেখে এলাম। মনে হচ্ছে এখানেও ল্যাপারোস্কোপির প্রয়োগ ফলপ্রসূ হবে। যন্ত্রের দাম ১৫ থেকে ২২ লক্ষ টাকা। আমরা টেন্ডার ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
তবে ল্যাপারোস্কোপি প্রক্রিয়ায় নির্বীজকরণে যন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে সরকারি পশু-চিকিৎসকদেরই একাংশের। তাঁদের মতে, এই ধরনের যন্ত্র চালানোর জন্য যে প্রশিক্ষণ দরকার, পুরসভার সংশ্লিষ্ট কর্মীদের তা নেই। পুরসভার চিফ মেডিক্যাল অফিসার টি কে মুখোপাধ্যায়ও বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে তাঁর বক্তব্য, “প্রয়োজনে পুরসভার পশু চিকিৎসকদেরই প্রশিক্ষণ দিয়ে এ বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা যেতে পারে।
প্রশ্ন উঠছে আরও। যেমন, বেলগাছিয়া পশু গবেষণা কেন্দ্রের এক বিশেষজ্ঞ বলেন, “ল্যাপারোস্কোপি করে একাধিক কুকুরের নির্বীজকরণ কতটা সম্ভব তা নিয়ে ঘোর সংশয় রয়েছে। চেন্নাই পুরসভা এ ব্যাপারে একটা চেষ্টা চালিয়েছিল ঠিকই তবে তা নিছকই পরীক্ষামূলক। তার উপরে যাঁরা চেন্নাই গেলেন, তাঁরা তো আর এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নন।” যন্ত্রটি সরেজমিনে দেখে আসতে মেয়র পারিষদের সঙ্গী হয়েছিলেন পুর-স্বাস্থ্য বিভাগের ওএসডি দেবাশিস সেন।
নির্বীজকরণ প্রকল্পে পুরসভার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা পশুপ্রেমী সংগঠনগুলিও ওই যন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান। এমনকী, প্রাণিসম্পদবিকাশ দফতরের সদ্য দায়িত্ব পাওয়া প্রতিমন্ত্রী হুমায়ুন কবীরও বলেছেন: “যন্ত্রটা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা দেখতে হবে তো!” |