কোর্টের বাইরে সমাধানের চেষ্টা
সিঙ্গুর-জট খুলতে কথার ইঙ্গিত দিলেন মন্ত্রীরাই
সিঙ্গুরের জমি বাঁচাতে এ বার পুরোদমে মাঠে নামল রাজ্য সরকার। সোমবার তাপসী মালিকের মৃত্যুদিনে যে ‘শহিদ দিবস’ পালনের অনুষ্ঠান ছিল এখানে, তাতে যোগ দিতে এসে সরকারের দুই মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু এবং সুব্রত মুখোপাধ্যায় বর্তমান আইনের বাইরে কিছু বিকল্পের কথা বলে গেলেন। পূর্ণেন্দুবাবু মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, “সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্গুর আইন গ্রাহ্য না হলে জমি ফিরিয়ে দিতে নতুন আইন করবে সরকার।” আর মঞ্চ থেকে নেমে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সুব্রতবাবু বললেন, “টাটারা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিক। মামলা তুলে নিক। আলোচনায় বসুক। আমরা রাজি আছি।”
দুই মন্ত্রীর কথায় তৈরি হল একাধিক জল্পনা। প্রশ্ন উঠল, রাজ্য সরকার কি তবে সুপ্রিম কোর্টে হারের আশঙ্কা করছে? সে জন্য এক মন্ত্রী নতুন আইনের কথা বলছেন, আবার অন্য জন টাটাদের সঙ্গে আদালতের বাইরে আলোচনা করে সমস্যা মেটাতে সরকারের আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন?
সিঙ্গুরের ভবিষ্যৎ এখন সর্বোচ্চ আদালতের হাতে। মমতার নেতৃত্বে অনিচ্ছুক চাষিদের ৪০০ একর জমি ফেরতের দাবিতে তীব্র আন্দোলন হয়েছিল সিঙ্গুরে। যার জেরে ন্যানো প্রকল্প গুটিয়ে সানন্দে চলে যায় টাটাগোষ্ঠী। ক্ষমতায় আসার পরে শপথের দিনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম ঘোষণাই ছিল সিঙ্গুর নিয়ে। তিনি জানিয়েছিলেন, আইন করে সিঙ্গুরে অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত দেওয়া হবে। সেই মতো আইন হয়, রাতারাতি টাটার জমি ফিরিয়েও নেয় রাজ্য। কিন্তু দেড় বছর কেটে গিয়েছে, এখনও অনিচ্ছুকরা সেই তিমিরেই। সিঙ্গুর আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যায় টাটা গোষ্ঠী। সিঙ্গল বেঞ্চে হেরে গেলেও ডিভিশন বেঞ্চে তারা জেতেও। সিঙ্গুর আইনকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে রাজ্য।
সিঙ্গুরে সুব্রত মুখোপাধ্যায়। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র
এর মধ্যে হতাশ সিঙ্গুরের বড় অংশই চাইছে, আদালতের বাইরে গিয়ে টাটাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা মেটাক সরকার। এ দিন সুব্রতবাবুর বক্তব্য সিঙ্গুরবাসীদের সেই দাবিকেই খানিকটা মান্যতা দিল।
এ দিন সিঙ্গুরে মুখ্যমন্ত্রী না গেলেও ছিলেন সুব্রতবাবু-সহ তৃণমূলের এক ঝাঁক নেতা। বক্তৃতা দেওয়ার পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রতবাবু। সেখানেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “চাষিরা চাইলে আদালতের বাইরেই সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া যেতে পারে।” তবে যোগ করেন, সে ক্ষেত্রে টাটারা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিক, মামলা তুলে নিক। আলোচনায় বসুক। আলোচনার ইঙ্গিত ছিল মন্ত্রিসভার আর এক সদস্য মদন মিত্রের কথাতেও, “চাষিরা এত দিন আন্দোলন করলেন। জয় যখন হাতের মুঠোয় তখন কেউ আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে চলে যায়? আমাদের জয় নির্ধারিত, সুনির্দিষ্ট। আলোচনা চলছে।” কার সঙ্গে আলোচনা? মন্ত্রীর কৌশলী জবাব, “সেটা সময়েই জানতে পারবেন। একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।” এরই মধ্যে আর এক মন্ত্রী পূর্ণেন্দুবাবুর ঘোষণা: সুপ্রিম কোর্টে আইন গ্রাহ্য না হলে নতুন আইন করবে রাজ্য। এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনে মমতার আর এক প্রধান কাণ্ডারী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কথাতেও এ দিন আদালতের বাইরে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার কথাই ছিল। তিনি বলেন, “চাষিরা চাইলে আদালতের বাইরে সমস্যা মিটিয়ে ফেলুক সরকার।” রবীন্দ্রনাথবাবু অবশ্য এ দিন ‘কৃষি জমি রক্ষা কমিটি’র আহ্বানে সাড়া দেননি। যাবতীয় কর্মসূচি থেকে দূরে নিজের বাড়িতেই সময় কাটিয়েছেন।

টাটারা নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিক, মামলা
তুলুক, বৈঠকে বসুক। আমরা রাজি।
সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পঞ্চায়েতমন্ত্রী

আলোচনা চলছে। কার সঙ্গে,
তা ঠিক সময় জানতে পারবেন।
মদন মিত্র, পরিবহণমন্ত্রী

সিঙ্গুর আইন সুপ্রিম কোর্টে গ্রাহ্য না
হলে নতুন আইন করবে সরকার।
পূর্ণেন্দু বসু, শ্রমমন্ত্রী

অনিচ্ছুকদের জমি ফেরানোর কথা
আমাদের মাথায় আছে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শিল্পমন্ত্রী
আপাত নিস্তরঙ্গ সিঙ্গুরের মাটিতে দাঁড়িয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের এই মন্তব্যে নড়েচড়ে বসে সকলে। তবে কি সুপ্রিম কোর্টে হারের আশঙ্কা করছে সরকার? তাই আদালতের বাইরে গিয়ে মীমাংসা সূত্র খুঁজছে তারা? এ বার খানিকটা রক্ষণাত্মক শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। প্রশ্নের জবাবে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। এখন এই নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়ার লক্ষ্য আমাদের মাথায় রয়েছে।” গতানুগতিক কথা শুনিয়েছেন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ও, “সামনের বার যখন এই দিনে এখানে আসব, তত দিনে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। চাষিরা জমি ফেরত পেয়ে যাবেন।”
শিল্পমন্ত্রী মন্তব্যে যেতে না-চাইলেও সরকারি সূত্রের খবর, টাটা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসে পথ বার করার সম্ভাবনা মহাকরণের ভাবনাচিন্তায় রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য রতন টাটার সঙ্গে আলোচনায় বসতে নারাজ। টাটা গোষ্ঠীর আনুষ্ঠানিক চেয়ারম্যানের পদ থেকে টাটা অবসর নিচ্ছেন ২৮ ডিসেম্বর। তাঁর জায়গায় সাইরাস মিস্ত্রি দায়িত্ব নিলে যাতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসা যায়, সেই প্রচেষ্টা জারি রয়েছে। বস্তুত, সিঙ্গুর জমি আন্দোলনের সহযোদ্ধা এবং পিডিএস নেতা সমীর পূততুণ্ডের সঙ্গে মহাকরণে সাম্প্রতিক আলোচনায় টাটাদের সঙ্গে আদালত বহির্ভূত সমঝোতার প্রশ্ন একেবারে খারিজ করে দেননি মমতা। তবে তৃণমূলেরই একটি সূত্রের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী চান সুপ্রিম কোর্টের রায় দেখে নিয়ে তার পরেই আদালতের বাইরের রাস্তার কথা ভাবতে।
এ প্রসঙ্গে অবশ্য মুখ খুলতে চায়নি টাটা মোটরস। সংস্থাটির মুখপাত্র এ দিন বলেন, “এ নিয়ে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই। কারণ বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন।”
মঙ্গলবার, তাপসী মালিকের মৃত্যুদিনে জমি আন্দোলনকে মনে রেখে নাটক মঞ্চস্থ হল সিঙ্গুরে। ছবি: দীপঙ্কর দে।
গত ছ’বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে ক্লান্ত সিঙ্গুর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে। সম্প্রতি সরকারি সাহায্যের চালের লাইন সামলাতে গিয়ে সিঙ্গুরবাসীর ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্নাকে। মমতার জমি আন্দোলনের মুখ সিঙ্গুরের মাটিতে জনসমর্থন যে কমছে, তা কিছু দিন ধরেই বুঝতে পারছিলেন তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ। সুব্রতবাবুর এ দিনের বক্তব্যেও যেন তারই প্রমাণ।
সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক চাষিদের কতটা জমি টাটাদের প্রকল্প এলাকায় অধিগৃহীত হয়েছিল, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, ৪০০ একর জমি অনিচ্ছুকদের ফেরত দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু এ দিন সুব্রতবাবু বলেন, “কত জমি তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। আমার হাতে তো ফাইল নেই। ৫০, ৭৫ বা ১০০ একরও হতে পারে। কাগজের হিসেব যা বলবে, সেই অনুযায়ীই অনিচ্ছুক চাষিরা জমি ফেরত পাবেন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.