পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের (১৮৬১-১৯৪৬) জন্মের সার্ধশতবর্ষ চুপচাপ পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শুধু সেই কারণেই তাঁর কথা মনে করছি না। শিক্ষা এবং রাজনীতির টানাপড়েন নিয়ে আজ যখন সওয়াল-জবাবের শেষ নেই, তখন তাঁর কাহিনি বিশেষ প্রাসঙ্গিক। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতা এবং বেনারস-হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও এককালীন উপাচার্য। তাঁর রাজনীতির একটা বড় লক্ষ্য ছিল দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা। আমরা মালব্যের হিন্দুত্ববাদী মতামত সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতেই পারি, সমালোচনা করতে পারি ‘শুদ্ধি’ আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে। কিন্তু অস্বীকার করা যায় না, নামে ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’ হলেও ওই প্রতিষ্ঠানকে যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ করে তুলতে তিনি প্রাণপাত করেছিলেন। শোনা যায়, হায়দরাবাদের নিজামের কাছে অনুদান চাওয়াতে ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়’-এর নামে ক্ষিপ্ত নিজাম তাঁকে জুতো উপহার দেন। মালব্য সে জুতো নিলাম করতে গেলে লজ্জিত নিজাম বহু অর্থমূল্যের বিনিময়ে নিজের জুতো ক্রয় করেন। মালব্য সেই অর্থ কাজে লাগান বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য।
১৯২০ সাল। গাঁধীর ডাকে দেশ জুড়ে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে। গাঁধী পড়ুয়াদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান করছেন। দু’জন বিশিষ্ট উপাচার্য এই বিষয়টি মানতে পারলেন না। এক জন কলকাতার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, অন্য জন বেনারসের মদনমোহন মালব্য। গাঁধী স্বয়ং এলেন বেনারসে। মালব্য তাঁকে আহ্বান জানান ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য। গাঁধী ছাত্রদের বললেন, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ দেশদ্রোহিতার শামিল। ছাত্রদের উচিত ‘স্বরাজ’ লাভের জন্য শর্তহীন ভাবে এই শিক্ষা বর্জন করা। মালব্য প্রতিভাষণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ না করার আহ্বান জানান। শিক্ষালাভ যে জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য, মনে করিয়ে দেন তা-ও। অবশ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব ছাত্রদেরই তিনি নিতে বলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর যে মডারেট কংগ্রেস রাজনীতিতে তাঁর অভিষেক, তা শিখিয়েছিল, রাজনৈতিক সংযোগের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষা। মালব্যের মতো নেতারা বুঝেছিলেন, স্বাধীন দেশের জন্য সব প্রতিষ্ঠান নির্মাণের দায়িত্ব ফেলে রাখা যাবে না। ঔপনিবেশিক আবহেই বীজ বপন করতে হবে। অমিত নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, আশুতোষ, সৈয়দ আহমেদ বা মালব্যরা তা-ই করে গেছেন। সারা দেশ থেকে এনেছেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের। যে গাঁধীর সঙ্গে প্রতি পদে বিরোধ, মালব্য তাঁকেই আহ্বান করেছেন ছাত্রদের লেকচার দেওয়ার জন্য। ডেকেছেন সি ভি রামন, প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশচন্দ্র এবং শান্তি স্বরূপ ভাটনগরকে। রবীন্দ্রনাথ ও অবন ঠাকুরের পরামর্শে গড়ে তুলেছেন কলাকেন্দ্র।
রাজ্যে শিক্ষা ও রাজনীতির দ্বৈরথ নিয়ে তোলপাড় চলছে। যেন দুই সতীনের গল্প। বস্তুত যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, রাজনীতি কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে করছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি নয়, শিক্ষার বিস্তার ও উৎকর্ষেরর জন্য রাজনীতিই কাম্য। শিক্ষায় রাজনীতি এবং শিক্ষার জন্য রাজনীতি সম্পূর্ণ দু’টি পৃথক বিষয়।
|
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |