পশ্চিমবঙ্গে নতুন সরকার আসার পর কাজকর্মের গতি ও ধরনধারণে এক ধরনের পরিবর্তন সর্ব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দু’জন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, মধ্যপ্রদেশকে বাদ দিলে, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা, শাসনব্যবস্থা, পরিকাঠামো ও বিনিয়োগ, সব মিলিয়ে ২০১১’র তুলনায় ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের উন্নতিই সবচেয়ে বেশি এক বছরে সতেরো নম্বর থেকে ছ’নম্বরে উঠে এসেছে এই রাজ্য। অথচ অনেকে একটা রব তুলেছেন, এই সরকারের যেন এখনই চলে যাওয়া উচিত!
এই অবধি পড়ে মনে হতে পারে, এই লেখা আমরা-ওরা’র ঝগড়াকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিংবা আবার সেই চৌত্রিশ বছরের ব্যর্থতা আর অনাচারের চর্বিতচর্বণ। একেবারেই তা নয়। আমি মনে করি, যে কোনও সরকারের মূল্যায়নে ভারসাম্যের একটা প্রয়োজন আছে। সেই ভারসাম্য রক্ষিত না হলে সমালোচনার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। বর্তমান রাজ্য সরকারের কাজকর্মের আলোচনায় ভারসাম্য ফেরানোর একটা চেষ্টাই এই লেখার উদ্দেশ্য। মতামত একান্তই আমার ব্যক্তিগত। |
আমি সরকারের একটি বিভাগে কাজ করি, যদিও সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। উচ্চশিক্ষা। কিন্তু রাজ্য যোজনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার সুবাদে অনেক বিভাগের কাজকর্মের খবর জানার এবং সে ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ আমার হয়েছে। নতুন সরকারের অভিজ্ঞতার প্রায় সবটারই আমি অংশীদার। অনভিজ্ঞতারও। আমাদের প্রতিনিয়ত অনেক কিছু শিখতে হচ্ছে। অনেক ধরনের নতুন কাজ করার চেষ্টা চলছে। যেমন, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন ভাল ছাত্র বা ছাত্রী কেন প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ পাবে না? এই জন্যই অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যাতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সহযোগিতা পায়, সে জন্য রাজ্য জুড়ে উদ্যোগ শুরু হয়েছে। দূরের কলেজগুলোর কথা মনে রেখে পরিবহণের উন্নতি সাধনের চেষ্টা চলছে। এগুলো কি আগের বিশ-ত্রিশ বছরে হওয়া উচিত ছিল না?
কলেজে কলেজে ‘অনলাইন’ ভর্তির প্রথা ও মেরিট লিস্ট কার্যকর হওয়ায় ভর্তির চত্বরে দুর্নীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। রাজ্যে চারশোটির ওপর কলেজ আছে। তার মধ্যে কয়েকটিতে, আমাদের হিসাব মতো দুই শতাংশ কলেজে, শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু অবাঞ্ছিত সমস্যা ঘটেছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে, গত দেড় বছরে শিক্ষার পরিসরে ‘একদলতন্ত্র’র অবসান হয়েছে। সংঘর্ষ বা অশান্তি অবশ্যই কাম্য নয়, কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অঙ্গ, অনেক কাল পরে সেই স্বাধীনতা এলে কিছু কিছু সংঘাত হয়তো অপ্রত্যাশিত নয়।
প্রসঙ্গত, আগের জমানায় বহু যোগ্য প্রার্থী কলেজে শিক্ষকতার চাকরি পাননি, এই সংক্রান্ত বহু মামলায় আদালতের রায় বিগত সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েছে। অনেক অশিক্ষক কর্মচারীর প্রাপ্য পদোন্নতি হয়নি, আদালতে আপিল করে করে মামলা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। বতর্মান সরকার সেই সব মামলা তুলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও কর্মীদের কাজ বা পদোন্নতির সুযোগ দিয়েছে। এই দিকটা নিয়ে খবর এত কম কেন?
এই সরকারের নেত্রী মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়াতে চান না বলে অনেক সমালোচনা। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে, শুধু নিয়মের বেড়াজাল কমিয়ে অর্থমন্ত্রী কর আদায় অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে বড় অঙ্কের উন্নয়নী ঋণ পেতে চলেছে এই রাজ্য; তার জন্য এডিবি যখন শর্তাবলি পাঠাল, তখন দেখা গেল, ডজন দুয়েক শর্তের প্রায় কোনওটাই বাকি নেই, কর ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার সব আগেই সম্পন্ন হয়েছে। কম্পিউটার মারফত টেন্ডার চালু করা হয়েছে, কর দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে। অনেক ব্যবস্থায় এই রাজ্য প্রথম। কিন্তু এই সব খবর খবর হয় না।
খবর হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে একটা কথা খেয়াল করা দরকার। নানা বিষয়ে কিছু দিন সরকারের প্রবল সমালোচনা শোনা যায়, তার পর আর সে বিষয়ে কিছুই শোনা যায় না। কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। এক সময় শোনা যাচ্ছিল, সরকার চেক দিয়ে শস্য কিনতে ব্যর্থ, চাষিরা শুধু আত্মহত্যা করছেন। ঘটনা হল, গত বছরে শস্য সংগ্রহে পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশে উপরের দিকে। এ বিষয়ে খবর আর শোনা যায় না।
শোনা যেত, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জঙ্গলমহল ও পাহাড়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবেন।’ ইদানীং আর এ বিষয়ে কোথাও প্রায় কোনও উচ্চবাচ্য নেই। কেন নেই? সম্প্রতি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সন্ধেবেলায় ফেরার সময় একটি ছোট রাস্তা দিয়ে আসছিলাম। সঙ্গের নিরাপত্তা কর্মী বললেন, বছর কয়েক আগে এ রাস্তা দিয়ে যাওয়া যেত না, মাইন-এর ভয়ে। জঙ্গলমহলে বর্তমান সরকারের ‘উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রিত আক্রমণাত্মক পদ্ধতি’র মডেলের প্রশংসা কেন্দ্রীয় সরকার বার বার করেছে। দার্জিলিঙে পর্যটকের ভিড় দিন দিন বাড়ছে, এখন সেখানে পর্যটনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিকাঠামো তৈরিই বড় সমস্যা, দার্জিলিং নিয়ে ‘গেল গেল’ রব আর শোনা যায় না। কেন? দেড় বছরের মধ্যে রাজ্যের দুটি বড় সমস্যা নিয়ন্ত্রণে এসেছে, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়? অনেকে বলছেন, ‘চাপা আক্রোশ’ এক দিন বারুদের মতো ফাটবে। এই যুক্তিতে তো যে কোনও শান্তিপূর্ণ অবস্থাকেই নস্যাৎ করে দেওয়া যায়।
শিশুমৃত্যু নিয়ে আগেও হইচই হয়েছে, এখনও হচ্ছে। লক্ষ করবেন, শিশুমৃত্যু নিয়ে কখনও শতকরা অনুপাতের হিসেব দেওয়া হয় না, সংখ্যা নিয়েই প্রচার চলে। প্রত্যেকটি মৃত্যুই মর্মান্তিক, কিন্তু পঞ্চাশ জনের মধ্যে পাঁচ জন মারা যাওয়া আর দুশো জনের মধ্যে পাঁচ জন মারা যাওয়া এক নয়। ঘটনা হল, প্রসূতিদের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা এখন অনেকটা সক্রিয়, অনেকেই প্রসবের জন্য জেলা হাসপাতালে আসছেন। ফলে হাসপাতালে প্রসবের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তাই দেখতে হবে, শিশুমৃত্যুর সংখ্যাবৃদ্ধির কতটা প্রসবের সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে আর কতটা গাফিলতির জন্য। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিকে অবশ্যই আরও চাঙ্গা করে তোলা দরকার, কিন্তু বেশি সংখ্যায় প্রসবের জন্য যদি শিশুমৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে থাকে, সেটা বিচার্য হবে না কেন?
গ্রামাঞ্চলে একশো দিনের কাজের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভাল, কেন্দ্রীয় সরকার নিজে সেই সার্টিফিকেট দিয়েছে। গ্রামে বিদ্যুতের প্রসার দ্রুত এগোচ্ছে, রাস্তাঘাট মেরামতি ত্বরান্বিত হয়েছে। অভিযোগ শুনে মন্ত্রী নিজে দু’রাত জেগে রাস্তা সারিয়েছেন, এমন ঘটনাও আছে। উট্রাম ঘাট থেকে প্রিন্সেপ ঘাট পর্যন্ত গঙ্গার তীর সুন্দর করে সাজানো কিংবা ত্রিফলা আলোয় কলকাতাকে সুন্দর করা, এগুলো ভাল কাজ নয়? কারচুপি হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই তা উদ্ঘাটন করা দরকার, কিন্তু তা বলে রাস্তার ধারে গাছ লাগানো বা আলো দিয়ে সাজানো, এগুলোর কথা ভুলে যেতে হবে?
পশ্চিমবঙ্গে সব সমস্যার সমাধান হয়নি। কোনও না কোনও ভাবে রাজস্ব আরও বাড়াতে হবে, তা না হলে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়িত হবে না। শিল্প নিয়েও অনেক কিছু করার আছে। বড় বড় শিল্প ছাড়া যে রাজ্যের কোনও গতি নেই, তা-ও নয়। মাঝারি শিল্পের বড় বড় জমি লাগে না, অথচ তার সম্ভাবনা বিরাট। সেগুলো যাতে ঠিক ঠিক এগোয়, তার দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। উপরমহলে বিপুল সদিচ্ছা ও উৎসাহ থাকলেও নিচুতলায় পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার উৎসাহ এখনও তুলনায় কম।
রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব বা গোষ্ঠীসংঘাত রাজনীতির ব্যাপার, সে বিষয়ে আমাদের মতো লোকের তেমন বলার কিছু নেই। কিন্তু সরকারি কাজে তার প্রভাব পড়া কখনওই উচিত নয়। বিশেষ করে আগের শাসক দল যে ধরনের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে, সেটা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া জরুরি। তবে একটা কথা মনে রাখা উচিত। সুপরিকল্পিত ভাবে, দলতন্ত্রের মাধ্যমে যাঁরা এত কাল দুর্নীতিতে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন, তাঁদের গলাতেই ‘তোলাবাজি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদধ্বনি শোনা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ইতিহাসকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না, তেমনই অস্বীকার করা যায় না তার দায়ভারকে। খুব নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত ভাবে তোলাবাজিকে সামাজিক অভ্যাস করে তুললে সেটা খবর হয় না। যখন ব্যবস্থাটা পাল্টানোর চেষ্টা হয় তখনই সংঘাতের সৃষ্টি হয়। তোলাবাজির মতো ব্যবস্থাকে নির্মূল করা অসম্ভব। কিন্তু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার পরিমাণ কমানোর প্রচেষ্টায় সরকার আপাতত নিয়োজিত।
আমার মতো রাজ্য-সরকারের সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা জানেন সরকারি কাজকর্মে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মুখ্যমন্ত্রীর অফিস থেকে ফোন আসে না যা যা কমিটি হয় তাদের সিদ্ধান্ত সঙ্গে সঙ্গে সরকারি নির্দেশিকা হিসেবে বের করার চেষ্টা করা যায়। এখানে একটা কথা বলি। সরকারি কমিটির রিপোর্টগুলির পরিণতি সচরাচর সুখের হয় না। এক বার যোজনা পরিষদের একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। যে টেবিলে চা দেওয়া হয়েছিল সেটি আসলে অনেক পুরনো রিপোর্টের সমাহারে তৈরি টেবিলাকৃতি একটি স্তূপ, সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা! সরকারি রিপোর্টের এক শতাংশ মতো কার্যকর হবে, এটাই দস্তুর। অথচ এই আমলে দেখছি, রিপোর্ট বস্তাবন্দি হয়ে থাকে না। যেমন, স্বাস্থ্য সংস্কারের জন্য তৈরি একটি কমিটি যা সিদ্ধান্ত নেয়, কিছু দিনের মধ্যেই তা কার্যকর হয়ে যায়। প্রতি মাসে উন্নয়নের টাকা কোন বিভাগে কেমন খরচ হচ্ছে, তা পর্যালোচনার জন্য রাজ্য যোজনা পর্ষদের সঙ্গে আধিকারিকদের মিটিং হয়, প্রতিটি বিভাগের রিপোর্ট মন্ত্রীদের মারফত মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যায়।
সরকারি আমলা এবং মন্ত্রীরা ‘ওভারটাইম’ কাজ করেন, কোনও দফতরে কাজ ঠিকমত না এগোলে ওপর থেকে প্রবল চাপ আসে। সেখানে কোনও বিভাগের ব্যর্থতা ধরা পড়লে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তাদের মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা শুনতে হয়, কিন্তু সেটাই তো স্বাভাবিক। অথচ তা নিয়েও একটা বিরূপতা তৈরি করা হচ্ছে। সে দিন শুনলাম, মুখ্যমন্ত্রী এত অসহিষ্ণু, এত খারাপ ব্যবহার করেন! এই প্রসঙ্গে একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি। যে কোনও মানুষের সঙ্গে খুব সহজ সাধারণ আন্তরিক ব্যবহারের যে অভ্যাস মুখ্যমন্ত্রীর দেখি, তা আমি আগে কখনও দেখিনি।
মুখ্যমন্ত্রীর রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত, জনসংযোগ রক্ষার ব্যাপারে তাঁর কী কর্তব্য, মানবাধিকার তিনি রক্ষা করছেন কি না, জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা কী হওয়া উচিত সবই নিরন্তর পাদপ্রদীপের আলোয়। ভুল হলে, অন্যায় হলে সমালোচনা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক, জরুরিও। কিন্তু সমালোচনার ‘কোটা’ পূরণ করতে গিয়ে, কেবলই ভুলের বাহুল্য নির্দেশ করতে গিয়ে আখেরে পশ্চিমবঙ্গেরই ক্ষতি হচ্ছে না তো? কোথাও একটা বড় রকমের অসঙ্গতি ও অন্যায় হচ্ছে না তো? অতীতের স্থবির শাসনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানো নতুন উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অসম্মান করা হচ্ছে না তো? নিরলস পরিশ্রমকে আঘাত করা হচ্ছে না তো? আমার মতো অনেকেই এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
|
লেখক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত। |