সেমন্তী ঘোষের বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত। (‘এ ভাবেই শিশুমঙ্গল’?, ৯-১২) মা-বাবা কী ভাবে সন্তানদের মানুষ করবেন, রাষ্ট্রই বলে দেবে? না-শুনলে নরওয়ের কল্যাণকর রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ‘চাইল্ড প্রোটেকশন সার্ভিসেস’ তুলে নিয়ে শিশুকে রাখবে সরকারের হেফাজতে। ছোট্ট অভিরাম ও শ্রীরামকে আপাতত মা-বাবাকে ছেড়েই থাকতে হচ্ছে। ওদের বাবা-মাকে ৪ ডিসেম্বর নরওয়ের অসলোর একটি আদালত কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে। কী কারণে? ভারতীয় এই দম্পতি বড় ছেলেকে (৭ বছর) বকাবকি করেছিলেন। কারণ, সে স্কুল বাসের মধ্যে প্রায়ই প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত প্যান্টে হিসু করে। তাই তারা (বাবা-মা) ছেলেকে ভয় দেখান, ‘আর একটি বার এমনি হলেই সোজা দেশে ফেরত’ অর্থাৎ হুমকি দেন। মানসিক নির্যাতন করেন। দুই শিশু ফস্টার কেয়ারের জিম্মায়।
এ ঘটনায় প্রথম প্রধান ও প্রবল প্রশ্ন থেকে যায়। যদি ধরে নিই তাদের বাবা-মা সংবেদনশীল নন, তাদের মানুষ করার নামে অত্যাচার করেন, শাসনের নামে নির্যাতন চালান, শারীরিক ও মানসিক ভাবে নিপীড়ন করেন তা হলে নরওয়ে সরকারকে প্রশ্ন, সন্তানদের জোর করে বাবা-মার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফস্টার কেয়ারে পাঠানোর মধ্যে নির্যাতন নেই তো? তা হলে কি শিশু মনস্তত্ত্বের কথা জানা সত্ত্বেও নরওয়ের কল্যাণকর রাষ্ট্র তাদের বাবা-মা হারা করে ছাড়ল। উল্লেখ্য, তিন বছরের ছোট্ট শিশুটি এক দিনও মা ছাড়া কাটায়নি।
লেখিকার সঙ্গে আমি একমত। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর ক্ষেত্রে নরওয়ের তুল্য সংবেদনশীল রাষ্ট্র পাওয়া ভার। কিন্তু সাধারণ ভাবে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে নরওয়ে সরকারকে কি সুস্থ সরকার বলা যায়? এটা ঠিক, পশ্চিম বিশ্বের দেশ আমেরিকা, ব্রিটেনের পরিবারগুলি জানেন, হাত দিয়ে খাওয়ানো, বাচ্চাকে কাছে নিয়ে শোওয়া বা শাসনের ঘটনা ঘটলে নরওয়ের পরিণতি ওই দেশগুলিতে হবে না। কারণ, ওই সব দেশে আছে কাউন্সেলিং সেশন, মনোচিকিৎকের চেম্বার, চাইল্ড কেয়ার কমিউনিটির উপদেশ। খুবই সহজে বাবা-মাকে আদালতে বা জেলে পাঠানো যায় না। নরওয়ে নামক কল্যাণকর রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহু ক্ষেত্রে চমৎকার হলেও তারা অতি রাষ্ট্রবাদী সমাজতন্ত্রী ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।
কী বলেছে নরওয়ের আইন। শিশু ও কিশোররা যদি এমন পরিবেশে থাকে যা তাদের পক্ষে মানসিক ভাবে ক্ষতিকর, সে ক্ষেত্রে শিশুকে রক্ষা করার দায়িত্ব নরওয়ে সরকারের। এর আগে দুই ভারতীয় শিশু খেলতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার অভিযোগে নরওয়ে সরকার তাদের ফস্টার কেয়ারে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। এক রুশ দম্পতির থেকেও দুই সন্তানকে কেড়ে নেওয়া হয় বকাবকির অভিযোগে। ছোট্ট শিশুটি এখনও ফস্টার কেয়ারে আছে। নরওয়ের আইনি ব্যাখ্যা: শিশুর বড় হয়ে ওঠা ও মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবেশ অন্তরায় হলে সে ক্ষেত্রে শিশুর ভালর জন্য অতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার। কেননা, শিশু রাষ্ট্রের সম্পদ।
ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে? একটা সমীক্ষা জানাচ্ছে, ভারতের শিশুরা আর বাড়িতে নিরাপদ নয়। বড় একটি কারণ মা-বাবার, বিশেষ করে জননীর মারের ভয়। ভারতীয় নারী তথা মেয়েদের মধ্যে নানা কারণে বাচ্চাদের প্রতি সহানুভূতির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। অনেক মা মনে করছেন প্রহার না-করলে বাচ্চার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। অথচ শিশু মনস্তত্ত্ব বলছে, নারী বা মায়েরাই শিশুদের ভাল শিক্ষিকা। বিশ্বময় নিরাপদ শৈশব গড়ার লক্ষ্যে ১১ ডিসেম্বর ১৯৯২ ‘রাষ্ট্রপুঞ্জ’ ও ২০০৯-এ ২৬ অগস্ট (জি ও নং ৩৫) ‘ভারতের শিক্ষার অধিকার বিল’ বিদ্যালয়ে দৈহিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে। ভারতের
সুপ্রিম কোর্ট ওই আইনকে আরও পোক্ত করে।
আমাদের ঘরে-বাইরে সর্বত্র সুরক্ষিত শৈশব উপহার দিতে আইনে অভাব নেই। শুধুমাত্র বিধি প্রণয়ন করে শিশুর গায়ে হাত তোলা বন্ধ অন্তত ভারতে সম্ভব নয়। শিশু বাবা-মায়ের হাতে মার খেয়ে আইনি সাহায্য নিতে পারবে, এমন সম্ভাবনা কম। কাম্যও নয়। বাস্তবের ভূমিতে যথেষ্টই বিপন্ন আমাদের দেশের বাচ্চারা। অভিভাবকরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিচ্ছেন। এক দিকে তাদের শৈশব নষ্ট হচ্ছে, অন্য দিকে, সফল হতে না-পেরে অপরাধপ্রবণতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। তা ছাড়া সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দেশেও চালু হোক পিতামাতার আদর্শ কাউন্সেলিং।
সোমেশ্বর মল্লিক। প্রাক্তন শিক্ষক, চক ইসলামপুর
|
যদুভট্টের খাতাটির প্রতিরূপ প্রকাশিত হোক |
বিষ্ণুপুরের সংগীতাচার্য যদুভট্টের গানের খাতা প্রসঙ্গে (১২-১২) প্রকাশিত চিঠির প্রেক্ষিতে জানাই, পঁচেটগড় জমিদার পরিবারটির আদি পুরুষ কালামুরারি দাসমহাপাত্র। কালামুরারির পুত্র শ্রীধরচরণ এবং তাঁর পুত্র কেশবরাজ। বংশের কীর্তিমান পুরুষ কেশবরাজের সময় জমিদারির বিস্তৃতি ঘটে। মুঘল বাদশাহের কাছ থেকে কেশবরাজ পেয়েছিলেন রাজ্য শাসনের সনদ এবং চৌধুরী খেতাব।
যাঁর আমন্ত্রণে আচার্য যদুনাথ পঁচেটগড় জমিদার পরিবারে সংগীত শিক্ষক হিসাবে অবস্থান করেছিলেন সেই চৌধুরী গোপেন্দ্রনন্দনকে ১২৫০ সালের অগ্রহায়ণে দত্তক নিয়েছিলেন অপুত্রক জমিদার কিশোরনন্দন দাসমহাপাত্র। ব্রজেন্দ্রনন্দন ছিলেন ধুরন্ধর পাখোয়াজি। গোপেন্দ্রনন্দনের দুই পুত্র জ্যেষ্ঠ ব্রজেন্দ্রনন্দন এবং কনিষ্ঠ যাদবেন্দ্রনন্দন। মাসিক পঁচিশ টাকা দক্ষিণায় আচার্য যদুনাথ ব্রজেন্দ্রনন্দনকে তালিম দিতে শুরু করেন। যদিও মাস ছয়েকের বেশি ছিলেন না পঁচেটগড়ে। যাওয়ার সময় আপনভোলা যদুনাথ তাঁর স্বহস্ত লিখিত গানের খাতাটি ফেলে চলে যান। যা বাংলার সাংগীতিক ঐতিহ্যের এক মূল্যবান সম্পদ।
বাঙালির সাংগীতিক ঐতিহ্যের এই মহার্ঘ দলিলটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ১২৩৭ সালে পঁচেটগড়ের চৌধুরী পরিবারের অধস্তন অধ্যাপক পিনাকীনন্দন চৈধুরী একটি ছোট প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন।
মহামূল্য খাতাটির একটি প্রতিরূপ মুদ্রণ প্রকাশিত হলে যদুভট্টর প্রতি যথার্থ সম্মান জ্ঞাপন করা হবে।
জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। অরবিন্দনগর, বাঁকুড়া |