প্রাথমিক আতঙ্ক কাটিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে দুর্গাপুরে জয় বালাজির ইস্পাত কারখানা। অচেনা লোকজনের হাতে মার খেয়ে অরুণ থাতৈ নামে যে জেনারেল ম্যানেজার রাজ্য ছাড়তে চাইছিলেন, তিনিও এখন অনেকটা আশ্বস্ত।
শনিবার আইএনটিটিইউসি-র বিক্ষোভের পরে রাতে আবাসন থেকে টেনে বের করে অরুণবাবুকে মারধর করে মাফলারে মুখ ঢাকা কিছু লোকজন। রবিবার তিনি জানিয়ে দেন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এ রাজ্য ছাড়ার কথা ভাবছেন। কিন্তু ওড়িশা থেকে আসা সেই অফিসারই মঙ্গলবার বলেন, “কর্তৃপক্ষ আমায় আশ্বস্ত করেছেন। আতঙ্ক অনেকটাই কেটে গিয়েছে।” এ দিনও অবশ্য তিনি কাজে যোগ দেননি। সে প্রসঙ্গে অরুণবাবু বলেন, “কাঁধে এখনও ব্যথা রয়েছে। কয়েক দিন বিশ্রামে থাকতে হবে।”
কিন্তু যে পরিস্থিতি থেকে গোটা সমস্যার সূত্রপাত, তার সুরাহা এখনও হয়নি। একে কারখানার আয় দিন-দিন কমায় কর্মীরা সঠিক সময়ে বেতন পাচ্ছেন। এর উপরে আবার তৃণমূল প্রভাবিত আইএনটিটিইউসি-র নামে দু’টি সংগঠন একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার এবং ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। এই দুইয়ে মিলে দুর্গাপুরে নামো সগড়ভাঙার ওই কারখানায় অশান্তি লেগেই রয়েছে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাতেই মিলেছে এমন তথ্য।
জয় বালাজির এই ইস্পাত কারখানা ২০০৩ সালে গড়ে উঠেছিল। উৎপাদন শুরু হয় বছরখানেকের মধ্যেই। প্রথম দিকে হাজার পাঁচেক কর্মী ছিল। তার মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক শ’পাঁচেক। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই সংখ্যা ক্রমশ কমেছে। কারখানা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, শুধু দেশে নয়, বিশ্ববাজারেও ইস্পাতের চাহিদা কমেছে। বেড়েছে লৌহ আকরিক, কয়লা ও বিদ্যুতের দাম। লৌহ আকরিক আসে মূলত ওড়িশা থেকে। কয়েক বছর আগেও কারখানার সংখ্যা কম থাকায় সহজেই তা মিলত। এখন সারা দেশেই কারখানার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। ওড়িশাতেও স্পঞ্জ আয়রন ও ইস্পাত কারখানা গড়ে উঠছে। ফলে তারাও ভিন্ রাজ্যে লৌহ আকরিক পাঠানো কমিয়েছে। জয় বালাজির দুর্গাপুরের কারখানার ভাইস প্রসিডেন্ট নিরঞ্জন গৌরীসারিয়ার আক্ষেপ, “এক দিকে উৎপাদনের খরচ বেড়েছে, অন্য দিকে চাহিদা কমায় উৎপাদিত পণ্যের দামও কমেছে। দুইয়ে মিলে লাভ ঠেকেছে তলানিতে।”
কারখানা সূত্রে জানা গিয়েছে, আগে সাধারণ শ্রমিক-কর্মীদের মাসের নির্দিষ্ট দিনে বেতন দেওয়া হত। এখন অন্তত ১০ থেকে ২০ দিন পরে বেতন হয়। আধিকারিকেরা সংখ্যায় মাত্র ২৫ জন। তাঁদের বেতন হয় কখনও এক মাস, কখনও দেড় মাস পরে। এই পরিস্থিতি কবে বদলাবে, তারও সুনির্দিষ্ট উত্তর জানা নেই কর্তাদের। কারখানার ভাইস প্রসিডেন্ট নিরঞ্জন গৌরীসারিয়ার বক্তব্য, “শুধু আমাদের কারখানায় নয়, পরিস্থিতি সারা দেশেই এক। কর্মীদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।” কিন্তু অনেকেই যে সে কথা শুনতে নারাজ, তারই প্রমাণ শনিবারের ঘটনায়। যার জেরে সংস্থার যুগ্ম ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজীব জাজোদিয়া বলে দেন, “ফের এমন ঘটনা ঘটলে কারখানা গুটিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করতে হবে আমাদের।”
অসীম প্রামাণিক নামে যে নেতার সঙ্গে কিছু কর্মী শনিবার দুপুরে সংস্থার কর্তাদের প্রশাসনিক বৈঠকে জোর করে ঢুকে পড়েছিলেন, তিনি নিজেকে কারখানার আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বলে দাবি করেন। তাঁর দাবি, ২০১০ সালে তৎকালীন রাজ্য আইএনটিটিইউসি সভাপতি পূর্ণেন্দু বসু তাঁদের সংগঠনকে অনুমোদন দিয়েছেন। আবার জেলা আইএনটিটিইউসি সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ওই কারখানায় তাঁদের সংগঠনের দেখভালের দায়িত্বে আছেন নারায়ণ মণ্ডল। কারখানা সূত্রের খবর, অসীমবাবুর সঙ্গে নারায়ণবাবুর অশান্তি লেগেই আছে। গত ২৬ জুলাই দু’পক্ষের সংঘর্ষে ১২ জন জখমও হন। পুলিশ দুই পক্ষের মোট ১৮ জনকে গ্রেফতার করে।
আইএনটিটিইউসি সূত্রের খবর, অসীমবাবু যে শুধু ওই ইস্পাত কারখানাতেই সংগঠন চালাচ্ছেন তা নয়, পাশের একটি বেসরকারি গ্রাফাইট কারখানাতেও তাঁদের সংগঠন রয়েছে। বস্তুত, দুর্গাপুরের প্রায় সব কারখানাতেই এ ভাবে আইএনটিটিইউসি-র নামে একাধিক সংগঠন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাদ নেই সরকারি সংস্থাও। দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেডে (ডিপিএল) তৃণমূল নেতা অপূর্ব মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে আইএনটিটিইউসি কার্য্যালয়ের উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। পরে আবার জেলার এক মন্ত্রীর উদ্যোগে আরও একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। সেখানে ঘুরে যান শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে একাধিক বার সংঘর্ষও হয়েছে।
জয় বালাজির ঘটনার পরে অবশ্য নতুন করে ‘এক শিল্প, এক সংগঠন’ নীতিতে জোর দিতে চাইছেন প্রভাতবাবুরা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, “একটি কারখানায় আইএনটিটিইউসি-র নামে একাধিক সংগঠন আর কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। যে কোনও কারখানায় একটিই শাখা থাকবে। কোনও অবস্থাতেই জঙ্গিপনা করা যাবে না। শ্রম দফতরকে সঙ্গে নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে হবে।”
কারখানার সিটু অনুমোদিত সংগঠনের সভাপতি তথা দুর্গাপুরের প্রাক্তন বিধায়ক বিপ্রেন্দু চক্রবতী বলেন, “একে রাজ্যে নতুন শিল্প আসছে না, তার উপর যা আছে সেখানেও শনিবারের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তা চিন্তার। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও কাঁচামাল সরবরাহের সুব্যবস্থা করা, কর্মী আধিকারিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখবে রাজ্য সরকার, এটাই আমরা চাই।” প্রভাতবাবু বলেন, “আমাদের নাম নিয়ে শনিবার যিনি বিক্ষোভ করেছেন, তিনি মোটেই আইএনটিটিইউসি অনুমোদিত নন। বিষয়টি নিয়ে রাজ্যস্তরে রিপোর্ট পাঠিয়েছি।” |