|
|
|
|
হুল্লোড় |
মেয়েদের হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা |
মেয়েদের দল বেঁধে দেশ জুড়ে ঘুরে বেড়ানো এখন ‘ইন’ থিং। নিরাপদে
ঘুরে বেড়ানোর সন্ধান দিচ্ছে আনন্দplus। শতরূপা চক্রবর্তী লিখছেন |
ক’ দিন ধরেই বেশ মন খারাপ তনয়ার। কলেজের পার্ট টু পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে সময় যেন কাটতেই চাইছে না। মন চাইছে দিন কয়েকের ছুটি। কোথাও একটা ঘুরে এলে বেশ হয়। কিন্তু বাবা-মার সঙ্গে যেতে ইচ্ছে করছে না। সেই তো মায়ের চেঁচামেচি-বকাবকি হজম করতে হবে। নিজের সঙ্গে সময় কাটানো হবে কি? তার থেকে ঢের ভাল যদি নিজেই কোথাও পালানো যায় কাছে-দূরের হাতছানিতে। সঙ্গে জুটিয়ে নিয়ে গোটা চার-পাঁচেক বন্ধু, থুড়ি বান্ধবী!
পুরোনো দিনের বঙ্গ-ললনাদের কথা মনে পড়ে যায়। যখন মেয়েরা ঘর থেকে বেরোনো মানেই বিড়ম্বনা। খড়খড়ি তুলে এক চিলতে আকাশ দেখতে গেলেও চারদিকে গুঞ্জন, ফিসফাস। কান পাতা দায়। হাজার একটা বিধি-নিষেধের বেড়াজালে জড়িয়ে থাকা। সময় পাল্টেছে। যুগের বিবর্তনে মেয়েরাও বদলে নিয়েছে নিজেদের। হালফিলের সমস্ত শাখাতেই যখন মেয়েদের নেক-নজর, তখন একা মেয়ে কিংবা মেয়ের দল একজোট হয়ে ডানা মেলতে বাধা কোথায়? ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, অতিরিক্ত চিন্তার বেড়াজাল থেকে পালিয়ে কয়েক দিন ফুরফুরে আমেজে গা ভাসাতে কে না চায়! বন্ধু-সঙ্গে মুক্ত বিহঙ্গ হওয়ার সাধ কম-বেশি সব মেয়ের মনেই লুকোচুরি খেলে। তার উপর হাতের কাছে যদি মেলে ঘর-পালানোর সুলুকসন্ধান ট্রাভেল এজেন্টের সহায়তা! আর বাকি থাকে অভিভাবকের অনুমতি। সেটা একবার পাওয়া গেলে তর কি সয়? |
|
আমরা পথে পথে যাব সারে সারে |
কলেজছাত্রী শর্মিষ্ঠা যেমন বলছিলেন, “বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলে আমি তো আনন্দে আত্মহারা। আমাদের একটা নিজেদের দল আছে। সব্বাই মেয়ে। প্রায়ই এ-দিক ও-দিক বেরিয়ে পড়ি সময় পেলেই।” কলেজছাত্রীদের একাংশ এই ব্যাপারে একমত। “ছেলেরা যদি দল বেঁধে ঘুরতে যেতে পারে, তবে আমরাই বা কেন পারব না? দল বেঁধে একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার মধ্যে আছে আলাদা আনন্দ। স্বাবলম্বী হওয়ার স্বাদ”, বললেন বছর তেইশের শ্রবণা ভুঁইয়া। প্রথম বার ঘুরতে যাওয়ার সময়ে অর্পিতার বাবা একটু গোমড়া মুখ করে ছিলেন। তবে আহ্লাদি মেয়ে বুঝিয়েসুঝিয়ে বাবাকে ঠিক রাজি করিয়ে ছেড়েছে। “বাবা নিজেই অবশ্য খোঁজ-খবর নিয়ে ট্যুর অপারেটর-এর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। আমরা চুটিয়ে আনন্দ করেছি”, বলছেন অর্পিতা। শুধু অল্পবয়সিরাই যে ঘুরতে যাওয়ার জন্য এক পা এগিয়ে রেখেছে এটা ভাবলে ভুল। সরকারি চাকুরিরতা শাশ্বতী বললেন, “আমি একা-একাই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। যেটা করব বলে মনে করি, করেই ছাড়ি। ডোন্ট গিভ আপ ইওর ট্রাভেল ড্রিমস।” অনেক সময় এমন হয়, হঠাৎ অপ্রত্যাশিত একটা ছুটি পাওয়া গেল। একটা ট্যুরে যাওয়ার জন্য মন আনচান করছে। অথচ সে ভাবে কাউকে পাচ্ছেন না যে সঙ্গ দেবে। অতি প্রিয় বন্ধুটিও সময় করে উঠতে পারছে না। ‘একলা চলো রে’ নীতি অবলম্বন করুন। মনে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রাখবেন না।
সুনয়নার সঙ্গে তাঁর স্বামীর মত মেলে না একেবারেই। তিনি উত্তর তো স্বামী দক্ষিণ। তাই ঘুরতে গেলে নিজের বেটার হাফকে নেওয়ার কথা মাথায়ই আসে না। বরং কলেজ জীবনের বন্ধু অরুণিমা আর শ্রুতির সঙ্গেই তাঁর জমে বেশি। তাই সপ্তাহান্তে মাঝেমধ্যে নিজেরাই ড্রাইভ করে চলে যান কাছেপিঠে। পুণেতে কর্মরতা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রিকির আউটিং মানেই মহিলা-সহকর্মীদের সঙ্গে উইকএন্ড ট্রিপ। কিন্তু শুধু মহিলাই বা কেন? হাসতে হাসতে বললেন, “মেয়েরা মিলে গল্পগুজব কিংবা মজা করব। তাতে ছেলেদেরই বা খামোকা মাথা গলাতে দেব কেন? শপিং-এর সময় ওরা ভীষণ তাড়াহুড়ো করে। আর বেড়াতে বেরিয়ে কেনাকাটা না করলে চলে?” তাই মেয়ে-মহলে ছেলের প্রবেশ একেবারেই মেনে নিতে পারা যাচ্ছে না।
|
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা |
কলেজ-গোয়ার্সরা পছন্দ করছেন কাছেই কোথাও দু’-এক দিনের জন্য বেরিয়ে পড়তে। সমুদ্র-সৈকতের সেই চিরাচরিত হাতছানিকে উপেক্ষা করা সহজ নয়। আর তাই তাজপুর, মন্দারমণি, বকখালি কিংবা চাঁদিপুরের সাগরবেলায় মন ভেজাতে চাইছেন তাঁরা।
এ ছাড়াও তালিকায় অবশ্যই রয়েছে অরণ্যের আকর্ষণ। “সেই কোন ছোটবেলায় বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ পড়েছিলাম। সেই থেকে অরণ্যের মাদকতা আমায় ছুঁয়ে যায়। তাই ডুয়ার্সের চাপরামারি, মূর্তি কিংবা ওড়িশার ভিতরকণিকার হাতছানিতে ছুটে যাই বারবার,” বললেন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী অনন্যা। মাঝবয়সি মহিলারা অবশ্য কাছাকাছি কোথাও যাওয়ার থেকে একটু দূরে কয়েক দিন কাটাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তাই তারা পাড়ি জমিয়েছেন ভিন্ রাজ্যে কিংবা ভিন্ দেশেও। শ্রেয়সীকে কাজের সূত্রে প্রায়ই দেশ-বিদেশ যেতে হয়। তাই সাহসী ডানায় ভর করে উড়ে বেড়াতেও তাঁর বিন্দুমাত্র ভয় বা সংকোচ নেই। “বন্ধুদের সঙ্গে এই অগস্টেই বেরিয়ে এলাম মরিশাস। ছ’ রাত, সাত দিন”, জানাচ্ছেন তিনি।
|
একাই যাব, একাই দু’টো ফুটিয়ে খাব |
দেশের মধ্যে ঘুরতে চাইলে বা দেশের বাইরে গেলে ভ্রমণ সংস্থার পরামর্শ নিয়ে তাদের সঙ্গে যাওয়া যেতে পারে।
কলকাতার এক বিখ্যাত ভ্রমণ-সংস্থার তরফে চন্দন দত্ত জানাচ্ছেন, “মুম্বই, কেরল ইত্যাদি রাজ্যে কয়েকটি ভ্রমণ-সংস্থায় মেয়েদের কথা ভেবে আলাদা প্যাকেজ রয়েছে। কেবল মাত্র মেয়েদের জন্য আমাদের নিজস্ব কোনও ট্যুর-প্যাকেজ নেই। ইন ফ্যাক্ট কলকাতাতে কোনও ভ্রমণ-সংস্থাতে এই জাতীয় পরিষেবা এখনও নেই। তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী যেখানে যেতে চান তার একটা ভ্রমণ-বৃত্তান্ত তৈরি করে দিই। ফ্লাইট টিকিটিং থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং, খাওয়া-দাওয়া কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সবই যথেষ্ট যত্ন সহকারে করে থাকি।”
অনেকেই ভ্রমণবিক্রেতার মাধ্যমে ঘুরতে যেতে চাইছেন। অন্তরার স্পষ্ট আক্ষেপ, “মুম্বই-দিল্লির মতো রাজ্যের ভ্রমণ-সংস্থাগুলো যদি মেয়েদের জন্য আলাদা করে ট্রাভেল-প্যাকেজ রাখে, কলকাতাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? এখানকার ট্রাভেল-এজেন্টগুলো হাল ধরলে ভাল হত।”
তবে আবার অনেকেই নাক সিঁটকোচ্ছেন। কারণ কোথাও ঘুরতে গিয়ে কারও তাঁবেদারি তাঁরা ঠিক মেনে নিতে পারবেন না। তা হলে যে একলা ঘোরার আনন্দটাই মাটি। সঙ্গোপনে নিজেদের মতো ঘুরতেই তাঁরা বেশি পছন্দ করছেন।
ভ্রমণের পরতে পরতে মিশে থাকবে স্বাধীনতার আনন্দ, হই-হুল্লোড় আর যা খুশি করতে পারার মজা। তাই বলি কী, সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়ুন আনন্দ খুঁজতে। শেক দেম আপ উইথ ট্রাভেল-গিরি। গল্প-আড্ডা-স্মৃতি একাকার হয়ে যাক।
|
টিপস |
• যদি ভ্রমণ-সংস্থার তত্ত্বাবধানে ঘুরতে যান তবে সেই সংস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুন।
• যে হোটেলে গিয়ে থাকবেন সেখানকার খোঁজ-খবর আগেভাগে নিয়ে রাখুন। মেয়েদের থাকার জন্য সেটা কতটা সুরক্ষিত তা জানা দরকার।
• নির্জন কোনও জায়গায় গেলে দিনের বেলা দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো ঘুরে নিন। সন্ধের পর বেরোনো কখনও কখনও বিপজ্জনক হতে পারে।
• পোশাক সম্পর্কে সচেতন হোন। তা যেন দৃশ্যদূষণের আওতায় না পড়ে। খুব সহজেই অবাঞ্ছিত লোকজনের আকর্ষণ এড়াতে পারবেন।
• নগদ টাকা বেশি নিলে বিভিন্ন জায়গায় রাখুন। একসঙ্গে কখনওই অনেক টাকা রাখবেন না।
• যদি হয়রানির শিকার হতে হয়, প্রতিবাদ করুন। রাস্তায় চেঁচিয়ে মাত করতে পারেন। পুলিশকে জানান। কিন্তু মুখ বুজে থাকবেন না।
• সাহস হারাবেন না। হতে পারে হঠাৎ দলছুট হয়ে পড়লেন। বুদ্ধি করে নিজেকে সামলান।
• বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। মেল বা মেসেজে সংক্ষিপ্ত ভাবে জানিয়ে দিন কোথায় আছেন।
• সাধারণ বুদ্ধি প্রয়োগ করুন। অপরিচিত কারও সঙ্গে খুব আলাপ জমে গেল। কিন্তু ‘ড্রিংক’ নৈব নৈব চ। |
|
|
|
|
|
|