এক-আধ জন নয়। নদিয়ায় মহিলাদের একটি হোম থেকে গত ক’বছরে তিরিশ জনেরও বেশি আবাসিক নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। এবং তাদের কাউকে কাউকে যৌন পেশায় নামানো হয়েছে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না খোদ মহকুমা প্রশাসন। গুড়াপের গুড়িয়া-কাণ্ডের পরে নদিয়ার শিমুরালির এই ঘটনা সামনে আসায় ফের প্রশ্ন উঠেছে রাজ্যে দুঃস্থ মহিলাদের নিরাপত্তা-ব্যবস্থা নিয়ে।
সম্প্রতি শিমুরালির ওই বেসরকারি হোম সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কল্যাণী মহকুমার মহকুমাশাসক রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। মহকুমাশাসক শৈবাল চক্রবর্তী তাতে জানিয়েছেন, গত ক’বছরে হোমটি থেকে ৩২ জন মেয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এদের কয়েক জনকে যৌন পেশায় নামানো হয়ে থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, পদাধিকারবলে ‘ভাগীরথী শিল্পাশ্রম’ নামে শিমুরালির সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হোমটির প্রেসিডেন্ট মহকুমাশাসক নিজেই।
ক’মাস আগে হুগলির গুড়াপে এমনই এক সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি হোমে গুড়িয়া নামে এক তরুণীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। তদন্তে পুলিশ-প্রশাসনের অনুমান, ওখানে আবাসিকদের উপরে নিয়মিত যৌন নির্যাতন চলত, যারই বলি হয়েছে গুড়িয়া। অভিযোগ, তাকে খুন করে হোম-চত্বরে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। হোমের ভিতরে যৌন-ব্যবসা চালানোর জন্যও আঙুল ওঠে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। রাজ্য তোলপাড় করা সেই গুড়িয়া-কাণ্ডের
রেশ না-মিলাতেই শিমুরালির হোম নিয়ে মহকুমাশাসকের এ হেন রিপোর্টে স্বভাবতই প্রশাসনের অন্দরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। |
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ‘ভাগীরথী শিল্পাশ্রম’ চালু হয়েছিল ১৯৪২-এ। দুঃস্থ ও অনাথ মেয়েদের পাশাপাশি নিষিদ্ধপল্লি থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদেরও এখানে রাখা হয়। কাগজে-কলমে আবাসিকের সংখ্যা ২৬২। কিন্তু তার ৩২ জনের কোনও হদিস নেই বলে রিপোর্টে জানিয়েছেন মহকুমাশাসক। রিপোর্টের বক্তব্য: বেশি সরকারি অনুদান পাওয়ার তাগিদে নথিতে আবাসিকের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়ে থাকতে পারে। পাশাপাশি আবাসিকদের একাংশের অভিযোগের ভিত্তিতে নির্যাতনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। “মেয়েদের হোমে হাতের কাজের ব্যবসা চালাচ্ছে বাইরের ব্যবসায়ীরা। নাবালিকাদের আধপেটা খাইয়ে
রান্না থেকে কাপড় কাচা, যাবতীয় কাজ করানো হচ্ছে।” রিপোর্টে লিখেছেন মহকুমাশাসক। এবং এরই প্রেক্ষিতে তাঁর আশঙ্কা, যে বত্রিশ জনের খোঁজ নেই, তাঁদের কাউকে কাউকে যৌন পেশা গ্রহণেও বাধ্য করা হয়ে থাকতে পারে।
বস্তুত এসডিও’র রিপোর্টের প্রতিফলন মিলছে কিছু আবাসিকের জবানিতেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নবম ও দশম শ্রেণির চার আবাসিক বলে, “শাসন না-মানলে মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ভাবে কয়েক জনকে তাড়ানো হয়েছে। ক’জন পালিয়েও গিয়েছে। যারা ফেরে না, কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। কিন্তু ওদের নাম হোমের খাতায় দিব্যি থেকে যায়।” আয়-ব্যয়ের কোনও রেজিস্টার বা ক্যাশবইও হোম-কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেননি বলে এসডিও-র রিপোর্টে জানানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পরে সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্তারা হোম পরিদর্শনে এসেছিলেন। অভিযোগ, হোম-কর্তৃপক্ষ তাঁদেরও ঠিকঠাক কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
হোম-কর্তৃপক্ষ কী বলেন?
তাঁরা অভিযোগ মানতে নারাজ। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: মহকুমাশাসক কোথায় কী রিপোর্ট দিয়েছেন, তাঁরা জানেন না। মন্ত্রীর পরিদর্শনের সময়ে তাঁদের হাতে কুড়ি জনের একটি ‘নিখোঁজ তালিকা’ ধরানো হয়, যাদের মধ্যে এক জন বাদে সকলেরই হদিস রয়েছে বলে হোম-কর্তৃপক্ষের দাবি। হোমের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক অঞ্জন চক্রবর্তীর কথায়, “মন্ত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। লিলুয়া হোম থেকে আসা একটি মেয়ে গত জুনে নিখোঁজ হয়েছে। পুলিশে ডায়েরি করলেও খোঁজ মেলেনি।
বাকিদের সকলে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি-বাকরি করছে। ওদের বর্তমান ঠিকানা-সহ একটি রিপোর্ট মন্ত্রীর অফিসে পাঠিয়েছি।”
সেই রিপোর্ট সম্পর্কে মহাকরণ বা মহকুমা প্রশাসন কেউই অবশ্য অবহিত নয়। এমনকী, পদাধিকারবলে হোমের ‘প্রেসিডেন্ট’ মহকুমাশাসকও নন। “এমন কোনও রিপোর্টের কথা আমাকে জানানো হয়নি।” বলছেন শৈবালবাবু। তবে রাজ্যের সমাজকল্যাণমন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রের ঘোষণা, “গুড়াপ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সমস্ত সরকারি-বেসরকারি হোমের অবস্থা যাচাই করছি। আমাদের নির্দেশে নদিয়ার হোমটি নিয়ে তদন্ত করে মহকুমাশাসক রিপোর্ট দিয়েছেন। তাতে বহু অনিয়ম ধরা পড়েছে। আমরা ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে সরকারি অনুদান বন্ধ করা হবে।”
মন্ত্রী এ কথা বললেও তাঁর দফতরের একটি মহলের দাবি, মাসখানেক আগে শিমুরালির হোমে মন্ত্রীর সেই পরিদর্শনের পরে কোনও ‘অজ্ঞাত’ কারণে গোটা ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। মহকুমাশাসক শৈবালবাবুর মন্তব্য, “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তদন্ত করেছিলাম। এখনও কিছু হয়নি। আবার যদি নির্দেশ আসে, সেই মতো ব্যবস্থা হবে।” |