স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানাইয়াছে, এই বৎসর এখনও পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী হানায় প্রাণহানির কোনও ঘটনা ঘটে নাই। বামপন্থী নেতারা এই সংবাদে যেন বিচলিত। কেন এমন হইল, তাঁহারা উত্তর খুঁজিতেছেন। কারণ পাওয়া গিয়াছে। সূর্যকান্ত মিশ্র বলিয়াছেন, মাওবাদী নেত্রী এখন তৃণমূলের ঘরের বউ, জঙ্গলমহলে শান্তি আসিয়াছে, তাহা আর বিচিত্র কী! পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতার যোগ্য উক্তিই বটে। দীর্ঘ দিন পরে জঙ্গলমহল কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়াছে, তাহাতে তাঁহার বিন্দুমাত্র খুশি হইবার জো নাই। কেন হানাহানি সাময়িক ভাবে হইলেও থামিয়াছে, সেই কারণ সন্ধানের প্রয়াস নাই শ্রীমিশ্র বক্রোক্তিতে ব্যস্ত। জঙ্গলমহলের উন্নয়নে মুখ্যমন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, তাহার কত ভাগ বাস্তবায়িত হইয়াছে, শ্রীমিশ্র সেই প্রশ্ন তুলিতে পারিতেন, নিজেদের আমলের খতিয়ান দিতে পারিতেন। কিন্তু তাহাতে বুঝি যথেষ্ট রাজনীতি হয় না। ‘রাজনীতি’র ধর্ম মানিয়াই তাঁহার সহকর্মী বিমান বসু আদিবাসীদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ছলে বলিয়াছেন, শান্তিপ্রিয় আদিবাসীরা প্রাপ্য বুঝিয়া না পাইয়া যদি বিদ্রোহ করেন, তবে কোনও সরকার তাহা আটকাইতে পারিবে না! কথা বলিবার পূর্বে ভাবিবার সু-অভ্যাস থাকিলে শ্রীবসু কিঞ্চিৎ লজ্জা পাইতেন। তাঁহাদের সরকার দীর্ঘ ৩৪ বৎসরে আদিবাসীদের জন্য ঠিক কী করিয়াছে, তাঁহার জানা উচিত। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার আদিবাসীদের জন্য গত দেড় বৎসরে কী করিয়াছে, সেই প্রশ্ন তুলিবার অধিকার তাঁহার অবশ্যই আছে। কিন্তু নিজেরা কী করিয়াছিলেন, তাহা একই সঙ্গে জানাইবার দায়ও বিলক্ষণ আছে। সেই দায় এড়াইয়া আঙুল তুলিবার রাজনীতিতে সংকীর্ণ বিরোধিতা আছে, গঠনশীল বিরোধীর ছায়ামাত্র নাই।
সূর্যকান্ত মিশ্র বা বিমান বসুর মন্তব্যগুলি প্রক্ষিপ্ত নহে। ইহাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির রাষ্ট্রভাষা যেখানে কোনও যুক্তিপূর্ণ আলোচনার অবকাশ নাই, বিশ্লেষণের স্থান নাই, কেবল যে কোনও প্রকারে বিরোধিতা করিবার চেষ্টা রহিয়াছে। যুক্তি দিয়া, তথ্য দিয়া আলোচনা করিতে হইলে পরিশ্রম প্রয়োজন, ব্যঙ্গোক্তি বা কটূক্তিতে তত খাটুনি নাই। অতএব রাজনীতিকরা সেই পথই বাছিয়াছেন। যে দোষে বামপন্থীরা দুষ্ট, তৃণমূল কংগ্রেসও সেই পথেরই পথিক। বামপন্থীদের দশ বৎসর মুখ না খুলিবার পরামর্শ দিয়া দলনেত্রী পথ দেখাইয়াছিলেন। তাঁহার অনুগতরা সেই পথেই অগ্রসর হইয়াছেন। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বহুআলোচিত। সম্প্রতি শুভেন্দু অধিকারী বামপন্থীদের সাপের সহিত তুলনা করিলেন, মদন মিত্র তাঁহাদের পথেঘাটে বাহির না হইবার পরামর্শ দিলেন। হায় পশ্চিমবঙ্গ! এই রাজ্যের নেতারা কালিদাসের বাড়া। তাঁহারা যে গাছের ডালে বসিয়া আছেন, তাহারই মূলে কুঠারাঘাত করিতেছেন। পশ্চিমবঙ্গ নামক গাছটিকে উপড়াইয়া ফেলিতে পারিলে বিরুদ্ধ গোষ্ঠী ধরাশায়ী হইবে, এই আশায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চির দিন থাকিবেন না, বিমান বসুরাও কালের গর্ভে মিলাইয়া যাইবেন। কিন্তু সর্বাঙ্গে কুঠারাঘাতের চিহ্নসমেত পশ্চিমবঙ্গ পড়িয়া থাকিবে। প্রকৃত অর্থে যাহাকে রাজনীতি বলে, এই রাজ্যে তাহা আর ফিরিবে বলিয়া আশা হয় না। রাজনীতির মুখোশে মুখ ঢাকিয়া চণ্ডীমণ্ডপই পশ্চিমবঙ্গে রাজত্ব করিবে।
দুর্ভাগা এই রাজ্যটির হৃদয় ফুঁড়িয়া একটিই প্রশ্ন উঠিয়া আসিতেছে কোন অভিশাপে এমন হইল? পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গজন দায় অস্বীকার করিতে পারেন না। তাঁহারা এই ক্ষুদ্রতার রাজনীতিতে মজিয়াছেন। তাঁহাদের অন্তরে যে চিরন্তন চণ্ডীমণ্ডপটির অবস্থান, রাজনীতিকরা তাহাকেই খুঁজিয়া পাইয়াছেন মাত্র। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যদি স্পষ্ট জানাইয়া দিতেন যে এই কুৎসার রাজনীতিতে তাঁহাদের আগ্রহ নাই, রাজনীতিকরা তাঁহাদের খেলার ভঙ্গি বদলাইতে বাধ্য হইতেন। কিন্তু না, গভীর চিন্তার সময় তাঁহাদের নাই, বিশ্লেষণ করিবার বা বুঝিবার ধৈর্য অথবা মেধাও নাই। ফলে চটজলদি যাহা পাওয়া যায়, তাহাতেই তাঁহারা চিত্ত বিনোদনের রসদ খুঁজিয়া পাইয়াছেন। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সভাতেও হাততালির রোল উঠিয়াছিল, সূর্যকান্ত মিশ্রের সভাতেও। নেতারা হাততালি বুঝেন। তাঁহারা প্রকৃতার্থে নেতা নহেন, তাঁহারা জনতার অনুসরণকারীমাত্র। জনতা যাহা চাহিয়াছে, নেতারা জোগাইয়াছেন। তাহাতে পশ্চিমবঙ্গের কপাল পুড়িল, এই যাহা। |