জনশ্রুতি, বেগম খালেদা জিয়া যে কোনও রাজনৈতিক সমাবেশে এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিলে, সাধারণত তার মধ্যে তিরিশ মিনিট ব্যয় করেন ভারত-বিরোধিতায়!
সেই খালেদা জিয়া গত ১৮ নভেম্বর ভারত সফর সেরে ফিরে আসার পর এক মাস কেটে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত চারটি জনসভা করেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। কক্সবাজার, উখিয়া, ঢাকা এবং বরিশালে। এ দেশের রাজনীতির কারবারিরা সবিস্ময়ে লক্ষ করছেন, ভারত শব্দটাই তাঁর অভিধান থেকে যেন উধাও হয়ে গিয়েছে! বাংলাদেশে ভোটের আগে বিএনপি-র এই পরিবর্তিত অবস্থান যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিষয়টি এমন নয় যে, খালেদার দল বিএনপি রাতারাতি নিজেদের অবস্থান বদলে মনমোহন সিংহ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। বরং দলীয় সূত্রের খবর, ভারত সম্পর্কে খালেদা জিয়ার এই নরম অবস্থান তাঁর নিজের দলের ভিতরেই প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে। গত সপ্তাহে বিএনপি-র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারত সম্পর্কে খালেদার এই নয়া নীতি নিয়ে তাঁর দলের অনেক নেতাই দ্বিমত পোষণ করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে যে, এক দিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে নতুন যুগের কথা বলা হচ্ছে। অন্য দিকে দলের ভারত নীতিতে কোনও পরিবর্তন না আনার কথাও বলা হচ্ছে। বিষয়টি পরস্পরবিরোধী। খালেদা পরিবারের ব্যক্তিগত বন্ধু এবং রাজনৈতিক পরামর্শদাতা মাহমুদুর রহমান এই নিয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, এই পরস্পরবিরোধিতা কি ভোটের আগে দলের হাসিনা-বিরোধিতাকে সর্বাঙ্গীন ভাবে লঘু করে দেবে না?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক কারবারিদের মতে, ভারত সম্পর্কে খালেদার এই তুলনামূলক নরম অবস্থান নিছকই কৌশলগত কারণে। সামনাসামনি উগ্র ভারত বিরোধিতা না-করে জামাতের মতো জোটসঙ্গীদের দিয়ে সেই কাজটা চালিয়ে যাচ্ছেন খালেদা। এটা ঘটনা যে, ভারতের সঙ্গে তিস্তা এবং সীমান্ত চুক্তি এখনও রূপায়ণ না করতে পারার প্রশ্নে যথেষ্টই কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রশ্ন উঠছে, তাঁর ভারত-বন্ধুত্বের ফলাফল নিয়ে। আওয়ামি লিগের একটি অংশও মনে করছে, এই দু’টি চুক্তির বিষয় নিয়ে প্রচার এতটা উচ্চগ্রামে নিয়ে যাওয়াটা হয়তো ঠিক হয়নি। আওয়ামি লিগের এক নেতার কথায়, “তিস্তা চুক্তি হলে সরাসরি ভাবে রাজশাহী এলাকা উপকৃত হবে এবং পদ্মায় পলি পড়ার হার কমে তা সচল হবে, এ কথা ঠিকই। কিন্তু গোটা দেশ জুড়ে তিস্তা নিয়ে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছে, তা প্রায় জাতীয় ইসু্যুর সমান!” ফলে প্রধানমন্ত্রীর উপর চাপ বেড়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ওই দুই চুক্তি না হওয়ার ফলে দেশের অভ্যন্তরে যে ভারত-বিরোধী আবেগ তৈরি হয়েছে, তাকে সুকৌশলে কাজে লাগাচ্ছে জামাত।
বাংলাদেশের বক্তব্য, মুখে ভারত-বিরোধী কোনও বিবৃতি না দিলেও খালেদা জিয়া পিছন থেকে গোটা পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছেন। আওয়ামি লিগের এমপি আব্দুর রহমানের কথায়, “পাকিস্তানের হাতে তামাক খেয়ে ভারতকে যতটা সম্ভব চাপে রাখতে জামাত প্রবল ভাবে সক্রিয়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতকে সব সময় অস্বস্তিতে রাখতে পারলে বেশ কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ সিদ্ধি হয়। এই কাজে পশ্চিম এশিয়ার কিছু দেশ টাকাও ঢালছে।” হাসিনা শিবিরের বক্তব্য, বৃহত্তর ভূ-রাজনীতির কথা মাথায় রেখে (মার্কিন-পাকিস্তান সম্পর্ক ইত্যাদি) বেগম জিয়া কৌশলগত ভাবে প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা বন্ধ রেখেছেন ঠিকই। কিন্তু ক্ষমতায় এলেই তিনি ফের পুরনো অবস্থানে ফিরবেন। ভোট যত এগিয়ে আসবে, জামাতকে কাজে লাগিয়ে দেশে অস্থিরতা তৈরির কাজটিও এগোবে।
তবে ঘটনা হল, শুধু মাত্র ভারত-বিরোধিতা দিয়ে যে ভোটের কিস্তি মাৎ করা যাবে না, তা বিলক্ষণ জানে বিরোধী জোট। তিস্তা বা সীমান্ত চুক্তি রূপায়নে ব্যর্থতা (যদিও দীপু মণি এখনও বলছেন, তাঁরা আশাবাদী, এই দু’টি চুক্তি সই করেই ভোটে যেতে পারবে হাসিনা সরকার) নির্বাচনী প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি, পদ্মায় সেতু নির্মাণে দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশ ছোঁওয়া দাম-সহ অনেক বিষয়ই গুরুত্ব পাবে বিরোধীদের প্রচারে।
তবে বিরোধীদের ভোট প্রচারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতে চলেছে ভোটের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়তে না-চাওয়া নিয়ে সরকারের যুক্তি। যা উড়িয়ে দিচ্ছে সরকার-পক্ষ। দীপু মণির কথায়, “বিএনপি-র কাছে প্রচারের অন্য কোনও হাতিয়ার নেই। তাই তারা এই ধুয়ো তুলেছে। আমরা যে ভাবে নির্বাচনী সংস্কার করেছি, তা যথেষ্ট স্বচ্ছ। কমিশনও এখন যথেষ্ট শক্তিশালী।” তাঁদের বক্তব্য, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ এবং শক্তিশালী করার জন্য খালেদা জিয়া যদি কোনও প্রস্তাব নিয়ে আসেন, তা হলে অবশ্যই আলোচনায় রাজি সরকার। |