এক সঙ্গে পড়া, প্রকল্প রূপায়ণে বাকি অনেক কাজ |
প্রতিবন্ধকতার জন্য একটি শিশুও না থেকে যায় শিক্ষার অঙ্গনের বাইরে। সেই উদ্দেশ্যেই সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্প ২০০১ সালে ‘জিরো রিজেক্শন পলিসি’ বা কাউকে না ফেরানোর নীতি নিয়েছিল। প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের মূল ধারার শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসাই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রকল্প চালু হওয়ার এক দশক পেরিয়েও সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার চিত্রটা খুব আশানুরূপ নয়।
সর্বশিক্ষা প্রকল্পের হিসাব অনুযায়ী, রাজ্যে ২.৮৫ লক্ষ পড়ুয়া প্রতিবন্ধকতার শিকার। প্রাথমিক স্কুলে এদের জন্য রয়েছে ৩ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থাও। তবু ৯৫ হাজার পড়ুয়ারই স্কুলের খাতায় নাম নেই। খাতায় নাম রয়েছে যাদের, তারাও স্কুলে আসছে কিনা, তদারকি হয় না, বললেন প্রতিবন্ধী কমিশনের এক আধিকারিক। একটি বেসরকারি প্রতিবন্ধী কেন্দ্রের কর্মী শম্পা সেনগুপ্তও বলেন, “সর্বশিক্ষা প্রকল্প আর শিক্ষার অধিকার আইনের চাপে স্কুলের খাতায় নাম উঠছে অনেকেরই। কিন্তু তার পরে উপযুক্ত নজরদারি বা প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা, দেখা হচ্ছে না।”
কী কী ব্যবস্থার অভাব দেখা যাচ্ছে?
প্রথম অভাব বিশেষ প্রশিক্ষণের। প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের জন্য রাজ্যে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক রয়েছেন ১৩৬৬ জন। কিন্তু সরাসরি প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগই পাচ্ছেন না তাঁরা। কেবল প্রশাসনিক কাজে লাগানো হচ্ছে তাঁদের। কিন্তু বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কার্তিক সাহার অভিযোগ, “প্রয়োজন বুঝে শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে না।”
সংশয় রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও। রাজ্য প্রতিবন্ধী কমিশনার মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, বেশির ভাগ প্রার্থীই আসছেন শুধু চাকরি করার মানসিকতা নিয়ে। পড়ুয়াদের প্রতি সহমর্মিতার অভাব থেকেই যাচ্ছে। বাঁকুড়ার বিজি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সুদর্শন পালের বক্তব্য, “প্রায়ই পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে এই পড়ুয়ারা। অথচ তারা অন্যান্য অনেক বিষয়ে পারদর্শী। তাদের বিশেষ নজর প্রয়োজন।”
স্কুলের পরিকাঠামোয়ও গলদ রয়ে গিয়েছে। শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী, শারীরিক প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের চলাফেরার জন্য ‘র্যাম্প’-এর (সিঁড়ির বিকল্প ঢালু রাস্তা) ব্যবস্থা থাকার কথা স্কুলে। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক মিলিয়ে মোট ৯২ হাজার স্কুলের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি স্কুলে র্যাম্প নেই। শম্পা সেনগুপ্তর কথায়, “অধিকাংশ শিক্ষকই জানিয়েছেন, পরিকাঠামোর অভাবে স্কুলের ভিতর এই ব্যবস্থা রাখা কার্যত অসম্ভব।” আবার র্যাম্প থাকলেই সমস্যার সমাধান হয় না। দক্ষিণ গড়িয়া যদুনাথ বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক মৃণাল কাঁসারী জানান, স্কুলে ঢোকার মুখে র্যাম্প থাকলেও দোতলা বা তিনতলায় প্রতিবন্ধী পড়ুয়ার উঠতে অসুবিধা হয়। ওই স্কুলেরই সপ্তম শ্রেণির এক পড়ুয়ার মা স্বপ্না সর্দার জানান, “আমার ছেলে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যায়। ওকে স্কুলে ক্লাস পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে হয়। বেঞ্চ সরিয়ে বসার জায়গাও করে দিতে হয়।”
সর্বশিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, অন্যান্য পড়ুয়াদের সঙ্গে পড়াশোনা করলেও প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের জন্য স্কুলে বিশেষ ঘরের ব্যবস্থা থাকার কথা। সেখানে আলাদা করে ওই পড়ুয়াদের পড়াবেন প্রশিক্ষিত শিক্ষকেরা। কিন্তু, কার্যত এমন কোনও ঘরের ব্যবস্থা নেই অধিকাংশ স্কুলেই। বড় জোর সার্কল লেভেল রিসোর্স সেন্টার দফতরে এমন ঘরের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রয়োজনে সেখানেই পড়ুয়াদের নিয়ে যেতে বাধ্য হন অভিভাবকেরা।
অনিয়ম রয়েছে ভাতাতেও। প্রতিবন্ধী কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের স্কলারশিপ বাবদ রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের তরফে মাসে ১১৫০ টাকা করে পাওয়ার কথা। মেদিনীপুর ব্লকের কেশবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র বিশ্বজিৎ মাহালা মূক ও বধির। তার বাবা বরুণ মাহালা জানান, এ বছর কিছুই পাওয়া যায়নি। কার্তিকবাবুরও অভিযোগ, বেশির ভাগ স্কুলেই প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের জন্য রাজ্য সরকারের ভাতা আসেনি। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির সমন্বয়ের অভাবেই এমন হচ্ছে।
অনেক দিন ধরেই প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন রুনা বসু। তাঁর বক্তব্য, “সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্যান্যদের সঙ্গে থেকে সমাজের সাধারণ নিয়মগুলি এই পড়ুয়ারা শিখছে ঠিকই। কিন্তু তাদের বিশেষ প্রয়োজনগুলি অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। এদের বিশেষ প্রয়োজনগুলি মেটাতে প্রয়োজন শিক্ষণ-পদ্ধতি নিয়েও নতুন ভাবনা চিন্তার।” |