সেই জমিতেই ফেরার ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন রতন টাটা
টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের পদ থেকে অবসর নেওয়ার ঠিক বারো দিন আগে রতন টাটার মুখে আবার ফিরে এল সিঙ্গুরের কথা। সংবাদসংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আর এক বার জানিয়ে দিলেন, সিঙ্গুর ছেড়ে চলে আসাটা তাঁর কাছে খুবই হতাশার। একই সঙ্গে অবশ্য ভবিষ্যতে সেখানে ফেরার ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন তিনি।
ঘটনাচক্রে আগামিকালই আরও এক বার শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেড় বছরের শাসনকালে তাঁর প্রতি যেমন শহুরে মানুষের কিছুটা মোহভঙ্গ হয়েছে, তেমনই আইনি জটে আটকে থাকা সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিরাও বলছেন, অনেক হয়েছে, আর না! জাতীয় স্তরেও বিভিন্ন কারণে তৃণমূল সরকার সমালোচনার মুখে। এই পরিস্থিতিতে সিঙ্গুর প্রসঙ্গ উস্কে দিয়ে কি কোনও বার্তা দিতে চাইলেন রতন টাটা, এই প্রশ্নও উঠেছে আজ। আর এর ফলে নতুন করে অস্বস্তিতে পড়েছে মমতার সরকার ও দল। তবু পাল্টা আক্রমণে না গিয়ে সাইরাস মিস্ত্রির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির দিকেই এখন তাকিয়ে রয়েছে তারা। টাটা নিজেও অবশ্য সিঙ্গুরে ফেরার সম্ভাবনা খারিজ করে দেননি। বরং জানিয়েছেন, সিঙ্গুরের জমিতে, যেখানে এখনও তাঁদের কারখানা রয়েছে, সেখানে টাটা মোটরস না হলেও ওই গোষ্ঠীর অন্য কোনও সংস্থা লগ্নি করতে পারে।

• সিঙ্গুর ছেড়ে চলে যাওয়াটা খুবই হতাশার। বুদ্ধবাবু পুলিশ দিতে
চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ দিয়ে কি কারখানা চালানো যায়?
• বুদ্ধবাবুকে শ্রদ্ধা করি। উনি শিল্পায়ন চেয়েছিলেন। কারখানা হলে ৭-৮ হাজার কর্মসংস্থান হত। • রায় না আসা অবধি ওই জমিতে টাটার কারখানা আছে। টাটা গোষ্ঠীর অন্য সংস্থাও লগ্নি করতে পারে।
তৃণমূল অবশ্য তাঁর এই যুক্তি খারিজ করে দিয়ে বলছে, সিঙ্গুরের জমি রাজ্যের হাতে রয়েছে। কিন্তু টাটার এই দাবি বা সিঙ্গুর নিয়ে তিনি যে ভাবে তৃণমূল নেত্রীরই পরোক্ষে সমালোচনা করেছেন, তার জবাবে পাল্টা আক্রমণে যেতে চাইছে না রাজ্য সরকার বা তৃণমূল। মমতার নির্দেশে এই বক্তব্যকে বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়ারই কৌশল নিয়েছে তৃণমূল। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় দাবি করছেন, আগামিকালের বৈঠকে টাটার মন্তব্য কোনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, সিঙ্গুরে মমতার আন্দোলন কখনওই শিল্পবিরোধী ছিল না। অনিচ্ছুকদের ৪০০ একর ফিরিয়ে দিয়ে বাকি জমিতে কারখানা করলে আপত্তি কিছু ছিল না। তবে ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে টাটা গোষ্ঠীর বিনিয়োগ নিয়ে তাঁর বক্তব্য, টাটা এ কথা আগে বললে ভাল হত! সরকারি সূত্রে অবশ্য জানানো হচ্ছে, সিঙ্গুর থেকে টাটা মোটরস বিদায় নিলেও টাটা গোষ্ঠীর অন্যান্য সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করেছে। আর তা তৃণমূলের জমানাতেই হয়েছে।
তৃণমূল নেতৃত্ব বরং তাকিয়ে টাটা গোষ্ঠীর নেতৃত্ব বদলের দিকে। ২৮ ডিসেম্বর রতন টাটার অবসরের পরে সেই পদে বসবেন শাপুরজি পালনজি গোষ্ঠীর সাইরাস মিস্ত্রি। যাঁর দাদা, ওই গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান শাপুরজি মিস্ত্রি কয়েক মাস আগেই মমতা-পার্থর সঙ্গে বৈঠক করেন। রাজ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর, জলবিদ্যুৎ, তথ্য-প্রযুক্তি পার্ক এবং সড়ক পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন তিনি। যেখানে রতন টাটার সঙ্গে রাজ্য সরকারের কোনও সম্পর্কই নেই, সেখানে মিস্ত্রিদের সঙ্গে এই সম্পর্ককেই আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন মমতা।
আজ কী বলেছেন রতন টাটা?
সংবাদসংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের উন্নতির কথা মাথায় রেখেই বিনিয়োগ করেছিলাম। ওই কারখানায় ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষের চাকরি হত।” আরও বলেছেন, “এ কারখানা থেকে এমন একটি পণ্য বেরোত, যা এ দেশে অন্য কোনও কারখানা থেকে আগে বেরোয়নি।” সিঙ্গুর আন্দোলন ও কারখানা প্রসঙ্গেই তাঁর মুখে উঠে এসেছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশংসা। তিনি বলেন, “বুদ্ধদেববাবুর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। আমার মনে হয়, তিনি পশ্চিমবঙ্গে শিল্প গড়ার বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন।” একই সঙ্গে সিঙ্গুরে ফেরার সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেই বলেন, “রায় না বেরোনো পর্যন্ত ওই জমিতে তাঁদের কারখানা রয়েছে। শুধু টাটা মোটরসই নয়, টাটা গোষ্ঠীর অন্য কোনও সংস্থাও লগ্নি করতে পারে।”
টাটা এ কথা আরও আগে বললে ভাল হত। অনিচ্ছুকদের জমি ফেরানোর প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, তখনই টাটারা আলোচনায় যেতে পারতেন।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিল্পমন্ত্রী
আশা করি, টাটার বক্তব্যে শাসক দলের চোখ খুলবে! কারখানা গড়তে এলে ওঁরা ছাড়া আর কোনও দল বাধা দেবে বলে মনে হয় না।
নিরুপম সেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী
কারখানা-বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে টাটা জানান, জমি আন্দোলন শুরুর সময়ে তাঁর প্রাথমিক ভাবে মনে হয়নি যে, এটা বড় আকার নেবে। কিন্তু পরবর্তী কালে তা এমন হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে টাটা মোটরস আর পশ্চিমবঙ্গে থাকতে পারেনি। ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর কলকাতায় সাংবাদিক বৈঠক করে সিঙ্গুর থেকে চলে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন তিনি। তখনই বলেন, “বলেছিলাম বন্দুক ঠেকালেও যাব না। কিন্তু মমতা তো ট্রিগার টেনে দিলেন!” এত দিন পরেও সেই প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর কথায়। বলেন, “বুদ্ধবাবু পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেন। কিন্তু পুলিশ দিয়ে শিল্প-কারখানা চালানো যায় না।”
প্রশ্ন হল, রতন টাটা এত দিন এই সব কথা বলেননি কেন? শিল্পমহল মনে করছে, টাটা ভেবেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে জমানা বদলের পরে দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা হবে। সিঙ্গুর নিয়েও নতুন সরকার বিকল্প প্রস্তাব দেবে। কিন্তু তা আসেনি। উল্টে গোটা বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে। মমতার সরকার দেড় বছর কাটিয়ে দিয়েছে। এখন তারাও প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি। রাজ্যের শিল্প-নীতি নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। সমালোচনা চলছে জাতীয় স্তরেও। তখনই ফের ঘা দিলেন টাটা।
টাটা মোটরসের সঙ্গে দীর্ঘদিন সরকারের যোগাযোগ সূত্র হিসেবে কাজ করেছেন যিনি, সেই বাম জমানার শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন আজ টাটার বক্তব্যে খুশি। তাঁরা এত দিন যা বলে এসেছেন, টাটাও একই কথা বলায় স্বস্তিতে সিপিএম নেতৃত্ব। নিরুপমবাবুর কথায়, “আশা করি, টাটার এই বক্তব্যে এখনকার শাসক দলের চোখ খুলবে। কারখানা গড়তে এলে এখন যাঁরা শাসক দল আছেন, তাঁরা ছাড়া আর কোনও বিরোধী দল বাধা দিতে যাবে বলে মনে হয় না।” কংগ্রেসের সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “গোঁয়ার্তুমির জন্যই সিঙ্গুরে শিল্প হয়নি। টাটা আবার পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে চাইলে স্বাগত।”
সিঙ্গুরের ওই জমিতে তাঁদের কারখানা এখনও রয়ে গিয়েছে বলে রতন টাটা এ দিন যে মন্তব্য করেছেন তা মানতে চাননি তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, “সিঙ্গুরে জমির স্বত্ব রাজ্য হাতে নিয়েছিল। এখন মামলা চলছে। কিন্তু এর মধ্যে কখনওই ওই স্বত্ব তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য টাটারা আবেদন জানায়নি। ফলে জমি রাজ্য সরকারের হাতেই।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.