কলিকাতা হাইকোর্টের নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি অরুণ কুমার মিশ্র প্রথম দিন হইতেই রাজ্যের কর্মসংস্কৃতির দুরবস্থার প্রতিবিধান করিতে মনস্থ করিয়াছেন। আইনজীবীদের সংগঠন বার অ্যাসোসিয়েশন তাঁহাকে সংবর্ধিত করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িলে কেন আদালতের কাজ বন্ধ করিয়া সভা করিতে হইবে, বক্তৃতা দিতে বা শুনিতে হইবে, তাহা প্রধান বিচারপতির বোধগম্য হয় নাই। তিনি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, বিলম্বিত বিচার অবিচারেরই নামান্তর। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা যে বিচারপ্রার্থী জনসাধারণের অশেষ দুর্গতি ডাকিয়া আনে, ইহা বিচারক, আইনজীবী, বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য কাহারও অজানা নয়। তবু যখন প্রধান বিচারপতিকে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করিয়া দিতে হয়, তখন সন্দেহ হয়, বিচারব্যবস্থার সহিত যুক্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সংস্থাগুলি হয়তো আপন কর্তব্য হইতে বিচ্যুত হইতেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের কর্মসংস্কৃতিতে অবশ্য সংবর্ধনা দেওয়া বা লওয়া, সভা করিয়া কোনও উপলক্ষ উদ্যাপন করা, নিরন্তর উৎসব পালন কিংবা জন্মমৃত্যুর বার্ষিকী পালনের ঐতিহ্য গত দেড় বছরে রীতিমতো সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই প্রেক্ষিতেই বার অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া সংবর্ধনাকে বিচার করিলে প্রধান বিচারপতি খানিক স্বস্তিতে থাকিতে পারিতেন। কিন্তু তিনি সম্ভবত ছুটি বা রকমারি কর্মবিরতি পালন মারফত কর্মহীনতার গড্ডলপ্রবাহে গা ভাসানোর বিশেষ পক্ষপাতী নহেন। তাই কর্মহীনতার সংস্কৃতি অনুশীলন করিয়া পশ্চিমবঙ্গের বিচারব্যবস্থা কী বিপুল পরিমাণ বকেয়া মামলার পাহাড় সঞ্চয় করিয়াছে, তাহার অস্বস্তিকর ফিরিস্তিটি আদালতের মুখের সামনে পতাকার ন্যায় টাঙাইয়া দিয়াছেন। তাহাতে চোখ বুলাইলে দেখা যাইতেছে, কলিকাতা হাইকোর্টে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার এবং রাজ্যের সব নিম্ন আদালতগুলিতে ২৬ লক্ষ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়! বিবেকবান প্রধান বিচারপতির স্বভাবতই মনে হইয়াছে, এই বিপুল পরিমাণ মামলা বকেয়া ফেলিয়া রাখিয়া কোনও রকম সংবর্ধনা, অনুষ্ঠান, উদ্যাপন বা পালনই গর্হিত বিলাসিতা, যাহা সর্বতো ভাবে বর্জনীয়। কিন্তু লক্ষণীয়, প্রধান বিচারপতির ‘তিরস্কার’-এর পরেও সংবর্ধনার পরে আদালতের কাজ আর হয় নাই।
প্রধান বিচারপতি বকেয়া মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কর্মবিরতির মেয়াদ কমাইয়া কর্মের মেয়াদ বাড়াইতে আগ্রহী। যেমন পক্ষ কালের গ্রীষ্মকালীন ছুটি, এক মাসের পূজার ছুটি এবং ১২ দিনের শীতকালীন ছুটিতে কেন আদালত বন্ধ থাকিবে, এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। সুপ্রিম কোর্ট বছরে অন্তত ১৬২ দিন আদালত চালু রাখার নির্দেশ দিয়াছে। ইহাও কি নিতান্ত কম নহে? বাকি দিনগুলি কি তবে বিচারক, আইনজীবী, মুহুরিদের ফিতা কাটিবার জন্য বরাদ্দ? এহ বাহ্য। প্রতিবাদী ধর্মঘট বা কর্মবিরতি পালন, মৃত সহকর্মীর শোকসভা ইত্যাদিতে ১৬২ দিনও কোনও আদালতে কাজ হয় না। গ্রাম-গঞ্জ,শহরতলি হইতে রৌদ্রে-বর্ষায়-শীতে অশেষ দুর্ভোগ সহিয়া বিচারের আশায় আদালত চত্বরে হাজির হওয়া বিচারপ্রার্থীদের মলিন, প্রত্যাশী মুখগুলি প্রধান বিচারপতির হৃদয় বিগলিত করিয়াছে। তিনি বিচারব্যবস্থায় কর্মসংস্কৃতি আমদানি করিতে ব্যগ্র। বাঙালির নিজস্ব কর্মবিরতি পালনের ঐতিহ্যের সহিত সবে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। ক্রমশ তিনি উপলব্ধি করিবেন। |