নামটি দীর্ঘতর হইয়াছে। পূর্বে ছিল: ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন, রিসেটলমেন্ট অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিল ২০১১; এখন হইল: রাইট টু ফেয়ার কমপেনসেশন, রিসেটলমেন্ট, রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি ইন ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন বিল। এক বৎসরের ব্যবধানে শব্দের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু কাজের কাজ? বিলটি মন্ত্রিসভার বিবেচনার জন্য প্রেরিত হইয়াছিল। ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধীর করস্পর্শ লইয়া ফিরিয়াছে। সরকার যদি বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে, তবে ৮০ শতাংশ মানুষের সম্মতি লইয়া করিতে হইবে। লক্ষণীয়, জমির উপর নির্ভরশীল মানুষের ৮০ শতাংশ নহে ব্যক্তিগত জমির ক্ষেত্রে মালিকের ৮০ শতাংশ; খাস জমির ক্ষেত্রে স্বত্বভোগীর। কেবল জমির মালিক কেন ক্ষতিপূরণের যোগ্য হইবেন? জমির উপর নির্ভরশীল ভাগচাষি, খেতমজুর ইত্যাদি বিভিন্ন বর্গের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কেন নয়? ইউ পি এ কথিত ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বা সর্বজনীন উন্নয়নের নীতিকাঠামোয় এই প্রশ্নের সদুত্তর নাই। অনুমান করা যায়, ক্ষতিপূরণের পরিধিটিকে সীমিত করিবার গূঢ় কারণটি অন্য। ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই জমির মালিকের সংখ্যা যত, জমির উপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা তাহার বেশ কয়েক গুণ বেশি। সম্মতির অঙ্ক হইতে নির্ভরশীল মানুষদের ছাঁটিয়া ফেলিতে পারিলে সমস্যা কমে মুখে যতই বলা হউক যে ৬৬ শতাংশের পরিবর্তে ৮০ শতাংশের সম্মতি লওয়া হইতেছে, প্রকৃত প্রস্তাবে অনেক কম সংখ্যক সম্মতির প্রয়োজন হইবে। জমি অধিগ্রহণের জন্য যে জনে জনে সম্মতি গ্রহণ করা সম্ভব নহে, এই কথাটি সরকারও বিলক্ষণ বুঝিয়াছে। কিন্তু রাজনীতিতে বাধিতেছে বলিয়া মুখ ফুটিয়া উচ্চারণ করিতে পারিতেছে না। সেই কারণেই ঘুরপথে হাঁটিতে হইতেছে।
দেশে যদি একটি যথার্থ জমির বাজার থাকিত, সেই বাজার যদি কুশলী হইত, তবে জমি কেনাবেচার প্রক্রিয়ায় সরকারের কোনও ভূমিকাই থাকিত না। যাঁহার জমি প্রয়োজন, তিনি বাজার দরে জমি কিনিয়া লইতেন। কিন্তু ভারতে সেই বাজার নাই। এই দেশের বহু রাজ্যেই জমি এমন খণ্ডিত যে খোলা বাজারে জমি কিনিয়া বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠা করা কার্যত অসম্ভব। অতএব, শিল্পের জন্য জমি প্রয়োজন হইলে সরকারকে মাঠে নামিতে হইবে। অর্থাৎ পরিস্থিতির দায়ে আদর্শ ব্যবস্থা হইতে চ্যুত হওয়া ভিন্ন গত্যন্তর নাই। কিন্তু তবে আর সংখ্যার দাসত্ব কেন? সরকার কত শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করিতে পারিবে, সেই নিয়ম বাঁধিয়া দেওয়ার অর্থ কী? কে বলিল, সরকারি অধিগ্রহণের জন্য যে ঊর্ধ্বসীমা ধার্য করা হইয়াছে, তাহাই কুশলীতম? সংখ্যাগুলি নেহাতই আকাশ হইতে নামিয়া আসিয়াছে। যেমন, সম্মতির ৮০ শতাংশের নিম্নসীমাও। আদর্শ পরিস্থিতিতে কাহারও জমি তাহার অসম্মতি সত্ত্বেও অধিগ্রহণ করা অনুচিত। কিন্তু যখন সেই আদর্শ হইতে সরিতেই হইবে, তখন ৮০ শতাংশকেই আঁকড়াইয়া ধরা কেন? প্রয়োজনে সরকার শিল্পের জন্য ১০০ শতাংশ জমি ১০০ শতাংশ জোর করিয়া অধিগ্রহণ করিয়া দিবে। সেই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া রাজনীতির ময়দানে সামলাইতে হইবে। রাজনীতির খেলায় অর্থনীতিকে, শিল্পকে বাজি ধরিলে চলিবে না।
তবে সরকারই যে অনন্ত কাল জমি জোগাড় করিয়া দিবে, তাহা নহে। স্বল্পমেয়াদে জমির বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া যেমন সরকারের দায়িত্ব, দীর্ঘমেয়াদে তেমনই জমির বাজার তৈরি করিয়া দিতে হইবে। ভারতে জমির বাজারের পথে একটি বড় অন্তরায় তথ্যের অপ্রতুলতা। তাহার একটি মোক্ষম উদাহরণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’-এর রূপকথা। কোথায়, কাহার মালিকানায় কত জমি রহিয়াছে, তাহা যদি না-ই জানা থাকে তবে ল্যান্ড ব্যাঙ্ক তৈরি হইবে কী ভাবে? এই তথ্য সংকলনের কাজটি জরুরি ভিত্তিতে আরম্ভ করা প্রয়োজন। এই তথ্যকে ‘আধার’ প্রকল্পের আওতায় আনা জরুরি। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করিয়া লইয়াছে। সেই দেশে তথ্যের অপ্রতুলতায় জমির বাজারের ন্যায় অতি জরুরি একটি জিনিস অচল হইয়া থাকিবে, তাহা মানিয়া লওয়া যায় না। |