আরও কয়েক দিন টানা ঠান্ডা থাকুক। বড্ড করে তেমনটাই চাইছেন এ রাজ্যের গুড় ব্যবসায়ীরা। অক্টোবরের মাঝামাঝি টানা দিন পাঁচেকের একটা ‘ইনিংস’ খেলেছে শীত। তাতেই রসে টইটুম্বুর খেজুর গাছের মুড়ো। বাজারে ভাল গুড়ের অভাব হচ্ছে না। তবুও বাঙালির শীতের অনিবার্য অনুষঙ্গ নলেন গুড়ের সরবরাহে যাতে ভাটা না পড়ে, সে জন্যই আরও টানা ঠান্ডার আকাঙ্ক্ষা ব্যবসায়ী-শিউলিদের (খেজুর রস সংগ্রহ করেন এঁরাই)।
শীতের শুরুতে শিউলিরা গ্রামে-গ্রামে মালিকদের সঙ্গে গাছ পিছু তিন কিলোগ্রাম করে গুড় বা সমান অঙ্কের টাকার কড়ারে খেজুর গাছের রস সংগ্রহের অধিকার পান (চলতি কথায় জমা নেওয়া)। অক্টোবর-নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত রস মেলে। এক-এক জন শিউলি পুরো মরসুমে ৩০০-৪০০ গাছ জমা নেন। এক-একটি কলসিতে (গাছপিছু একটি) গড়ে দৈনিক ৩০০ মিলিলিটার করে রস হয়। জ্বাল দিয়ে এক কিলোগ্রাম গুড় পেতে অন্তত চার কলসি রস লাগে। একটি গাছ থেকে চার-পাঁচ দিন রস পাড়ার পরে নিদেনপক্ষে চার দিন জিরেন (বিশ্রাম) দিতে হয়। ফের যখন সে প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন প্রথম দিনের রস থেকে তৈরি হয় নলেন গুড়। যার চাহিদা আকাশছোঁয়া। এ ছাড়া, অন্য সময়ের রস থেকে তৈরি ঝোলা গুড়, দানা গুড় এবং পাটালিও রয়েছে।
গত বছর দু’য়েক খোলা বাজারে নলেন গুড়ের দর ছিল ৮০ টাকা কিলো। এ বার তা ১০০-১২০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। চাহিদা বাড়ল না কি? বর্ধমানের কাটোয়ার পাটুলি এলাকার ব্যবসায়ী সাজিস দফাদার বলছেন, “চাহিদাও বেড়েছে। এ বার খুব ভাল গন্ধের গুড়ও পাওয়া যাচ্ছে। দাম তো বেশি হবেই।” কাটোয়া ছাড়াও নদীয়ার হাঁসখালি এবং উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটে পাওয়া যায় খেজুরগুড়। সর্বত্র ভাল রস মিলেছে। গুড়ও হয়েছে দেদার। |
নলেনগুড়ের কেক বানানোয় প্রসিদ্ধ এক কেক প্রস্তুতকারী সংস্থার কর্ণধার স্বপন ঘোষ জানিয়েছেন, অন্য বার ৫০০ কিলো গুড়ে কাজ চালান তাঁরা। চাহিদা বাড়ায় এবং ভাল জিনিস পেয়ে এ বার ভাবছেন এক-দেড় টন গুড় তুলবেন বাজার থেকে। মিষ্টিতে নলেন গুড়ের ব্যবহারকে প্রায় গবেষণার স্তরে নিয়ে যাওয়া রিষড়ার এক মিষ্টি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অমিতাভ মোদক, কলকাতার প্রসিদ্ধ মিষ্টি ব্যবসায়ী প্রশান্ত নন্দীরাও জানিয়েছেন, প্রতি বছর চাহিদা বাড়ছে নলেন গুড়ের মিষ্টির।
কিন্তু মিষ্টি ব্যবসায়ী মহলের বক্তব্য, এ বছর নলেন গুড়ের জোগান ভাল। কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। “তেমন রস পেতে হলে টানা ঠান্ডা পড়তে লাগবে”, বলছেন পেশায় শিউলি মানিক দফাদার, বাবলু দফাদারেরা। তাঁদের বক্তব্য, “প্রথম দফায় টানা কয়েক দিন ঠান্ডা পড়ায় গাছের মুড়োয় রস জমে গিয়েছে। আর এক-দু’বার এমন হলেই গোটা মরসুম রসের জোগান দিতে পারব।” তবে শিউলি এবং গুড় ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, অবাধে খেজুর গাছ কাটা, রস পাড়ায় দক্ষ লোকের অভাবের মতো কারণে গুড়ের জোগান পর্যাপ্ত স্তরে পৌঁছচ্ছে না। “নলেন গুড় বাংলাকে বিশ্বে এক অনন্য পরিচিতি দিয়েছে”, মন্তব্য সাহিত্যিক শঙ্কর-এর। বলছেন, “অনাদরে যেখানে সেখানে জন্মায়, বাড়ে খেজুর গাছ। বন সৃজন প্রকল্পে রাস্তার ধারে খেজুর গাছ লাগানো যায় না! তা হলে নলেন গুড় কী করে পাব, তা আর ভাবতে হয় না?” |