কয়েক দিন আগে কলকাতায় এসে এ রাজ্যে বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় অর্থ লগ্নি সংস্থার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গিয়েছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর-সহ শীর্ষ কর্তারা। এ বার একই বিষয়ে রাজ্যকে সতর্ক করলেন কেন্দ্রের কোম্পানি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সচিন পায়লট। শহরে এসে তিনি এ-ও জানিয়ে গেলেন, ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের স্বার্থ সুরক্ষার তাগিদে কেন্দ্রীয় সরকার আরও কড়া হচ্ছে। সে জন্য নতুন কোম্পানি-আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার সংস্থান রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
রবিবার কলকাতায় বণিকসভা মার্চেন্ট চেম্বারের সভায় ভুঁইফোঁড় লগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে সরব হয়ে পায়লট বলেন, আর্থিক জালিয়াতি বিপজ্জনক ভাবে বাড়ছে। পরিণামে সারা জীবনের সঞ্চয় খুইয়ে পথে বসার অবস্থা হচ্ছে বহু মানুষের। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, “আজ দু’লাখ টাকা নিয়ে ছ’মাস পরে কেউ কী ভাবে পাঁচ লাখ দেবে?” আমানতের উপরে কুড়ি-তিরিশ শতাংশ হারে সুদকে ‘অস্বাভাবিক’ অভিহিত করে পায়লট জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অসম, মহারাষ্ট্র, সিকিম, মধ্যপ্রদেশ-সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এই বিপদের কবলে পড়েছে।
|
অনুষ্ঠানে পায়লট।
—নিজস্ব চিত্র |
পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং অভিযোগ উঠেছে, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা হরেক অর্থ লগ্নি সংস্থা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা সেবি-র নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না-করে বিভিন্ন অননুমোদিত প্রকল্প মারফত আমজনতার কাছ থেকে টাকা তুলছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে মোটা টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে লগ্নিকারীদের পথে বসাচ্ছে। বহু ক্ষুদ্র আমানতকারী বাড়তি আয়ের আশায় ওদের কাছে টাকা গচ্ছিত রাখায় ব্যাঙ্ক যেমন ব্যবসা হারাচ্ছে, তেমন সঙ্কটে রাজ্যও। রাজ্যের স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে জমার পরিমাণ কমছে। স্বল্প সঞ্চয়ে জমার নিরিখে কেন্দ্রের থেকে রাজ্য ঋণ পেতে পারে। সেই ভাঁড়ারে টান পড়ায় কেন্দ্রীয় ঋণও কমছে।
অত্যধিক লাভের টোপ দেওয়া এই সব অর্থ লগ্নি প্রতিষ্ঠানের রমরমার দিকেই সম্প্রতি রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গিয়েছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ডি সুব্বারাও। আর এ দিন কেন্দ্রীয় কর্পোরেট বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর আক্ষেপ, আইনের ফাঁক-ফোকরের সুযোগ নিয়েই কিছু সংস্থা সাধারণ মানুষকে এ ধরনের ‘পনজি স্কিম’-এর ফাঁদে ফেলছে। তাই আইন কঠোর করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। মন্ত্রীর বক্তব্য: আইন, এবং তা প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন সরকারি এজেন্সি থাকলেও এ হেন অপরাধ প্রতিরোধে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণে সক্রিয়তার অভাব প্রকট বিভিন্ন স্তরে। যখন এমন কিছু ঘটে, এজেন্সিগুলো যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে আমজনতার সঞ্চিত অর্থ গায়েব হয়ে গিয়েছে। “তাই আমরা চাই, আগেই হুঁশিয়ার হতে। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষিত করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য।” মন্তব্য পায়লটের।
এবং এই লক্ষ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মহলের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কেন্দ্রের কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রক কিছু ব্যবস্থা নিতে চলেছে বলে তাঁর কথায় এ দিন আভাস মিলেছে। পায়লট জানান, আজ সোমবার সংসদে নয়া কোম্পানি বিল পেশ হতে পারে। সেখানে আর্থিক অপরাধ রুখতে আরও কিছু ব্যবস্থার সংস্থান থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন, মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও) এই জাতীয় অভিযোগের তদন্ত করলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে কার্যত অপারগ। এ বার এসএফআইও-র হাতে বাড়তি ক্ষমতা দেওয়া হতে পারে। উপরন্তু আর্থিক জালিয়াতি-দুর্নীতি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় সরকার তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্য আরও বেশি করে নিতে চায়, পাশাপাশি রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ-এর নিয়ম-কানুনে নতুন কিছু মাপকাঠি আনার চিন্তা-ভাবনা চলছে। উল্লেখ্য, রাজ্য সরকারও আর্থিক অপরাধদমন শাখাকে বাড়তি ক্ষমতাদান ও প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনে উদ্যোগী হয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আশ্বাস, এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য রাজ্যকে যতটা সম্ভব সাহায্য করতে দিল্লি তৈরি।
তবে রির্জাভ ব্যাঙ্কের কর্তাদের সুরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও এ দিন আমানতকারীদের একাংশের ‘সচেতনতার অভাবের’ প্রসঙ্গ তুলেছেন। তাঁর দাবি: বড় শহরের বড় আমানতকারীরা অনেকে পনজি-প্রকল্পের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হলেও ছোট শহরের ক্ষুদ্র লগ্নিকারীদের একটা বড় অংশের কাছে তা ততটা স্পষ্ট নয়। আমজনতার মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতেও কেন্দ্র উদ্যোগী হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। অভিযুক্ত অর্থ লগ্নি সংস্থাগুলোর ‘রাজনৈতিক যোগসাজশ’ সংক্রান্ত যে অভিযোগ, সে সম্পর্কেও পায়লটকে এ দিন প্রশ্ন করা হয়।
তিনি অবশ্য অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কোনও মন্তব্য করতে চাননি। |