আর্থিক সংস্কার থেকে শিল্পের জন্য জমি নীতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোভাব বিলক্ষণ জানে শিল্পমহল। গত কাল বণিকসভা ফিকি-র সভাতেও নিজের মত স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। এই অবস্থায় সোমবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে শিল্পপতিদের মুখোমুখি হয়ে মুখ্যমন্ত্রী আরও একবার পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের আহ্বান জানাতে চলেছেন। প্রশ্ন উঠছে, কী এমন নতুন বার্তা দেবেন তিনি, যাতে শিল্পপতিরা কলকাতার বিমান ধরবেন?
শিল্পমহলের স্পষ্ট অবস্থান হল, তারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আর্থিক সংস্কারের কথা শুনতে চায়। শুনতে চায় স্পষ্ট জমিনীতির ঘোষণা। করছাড়ের ইঙ্গিত। দ্বিতীয় ইউপিএ-সরকারের জমানায় এত দিন পর্যন্ত সংস্কারের পথে বিশেষ অগ্রগতি হয়নি বলে একাধিক বার প্রকাশ্যেই অসন্তোষ জানিয়েছে শিল্পমহল। এমনকী মনমোহন-সরকারের বিরুদ্ধে নীতি-পঙ্গুত্বের অভিযোগ তুলতেও পিছপা হয়নি তারা। কিন্তু গত তিন মাসে একাধিক ক্ষেত্রে সংস্কারের রথ ছুটিয়ে শিল্পপতিদের হারানো আস্থা অনেকটাই ফিরে পেয়েছেন মনমোহন। গত কাল বণিকসভা ফিকি-র মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যা বলেছেন, তাতেও মোটের উপর সন্তুষ্ট বণিকমহল।
অন্য দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান একেবারেই বিপরীত মেরুতে। ফিকি-র ওই মঞ্চে দাঁড়িয়েই মমতা যা বলেছেন, তাতে তাঁর ভোটব্যাঙ্কের খুশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শিল্পমহলের মুখে হাসি ফুটছে না। অন্তত এখনই। ফলে আগামিকাল শিল্পমহলের সঙ্গে তাঁর বৈঠক কলকাতায় শিল্পপতিদের সঙ্গে বিজয়া সম্মিলনীর মতোই আরেকটি নিছক সৌজন্য বৈঠক হয়ে উঠবে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে।
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য আজ দাবি করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী যে সার্বিক উন্নয়নের কথা বলছেন, তা শিল্পমহলকে আশ্বস্ত করেছে। বিনিয়োগের জন্য পশ্চিমবঙ্গই যে শ্রেষ্ঠ গন্তব্য, সেই বার্তা দেওয়া যাচ্ছে। বিনিয়োগ টানতেই মমতা আগামী মাসে হলদিয়াতে ‘বেঙ্গল লিডস’-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের আয়োজন করেছেন। পার্থবাবু বলেন, “ফিকি-র সভায় মুখ্যমন্ত্রী নিজে বক্তব্য রাখলেও শিল্পপতিরা প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি। আগামিকাল তাঁরা সরাসরি নিজেদের প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন।” বামফ্রন্ট জমানায় শিল্প নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে সিপিএমের বিরোধের দিকে ইঙ্গিত করে পার্থবাবু বলেন, “আমাদের সবথেকে বড় সুবিধা হল, মুখ্যমন্ত্রীই শাসক দলের প্রধান।”
কিন্তু প্রশ্ন হল, শিল্পের জন্য জমি আসবে কোথা থেকে? রাজ্য সরকার ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’-এর কথা বলছে, সেখানে বড় শিল্পের জন্য এক লপ্তে বড় জমি নেই। অধিকাংশ জমিই বেখাপ্পা মাপের। জমির ঊর্ধবসীমা শিথিল করার ক্ষেত্রেও রাজ্য অনড়। পার্থবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, জমি নিয়ে কোনও সমস্যাই হবে না। ল্যান্ড ব্যাঙ্ক এবং বিভিন্ন দফতরের কাছে যে জমি রয়েছে, তা-ই যথেষ্ট বলে তাঁর দাবি। সম্প্রতি রাজ্য সরকার যে জমি বণ্টন নীতি ঘোষণা করেছে, সেখানেও অনেক স্বচ্ছতা আনা হয়েছে বলে মত পার্থবাবুর।
জমি নিয়ে অনড় মনোভাবের পাশাপাশি কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও জেহাদ ঘোষণা করে বসে আছে রাজ্য। আজও পার্থবাবু অভিযোগ তুলেছেন, তাঁদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার হলদিয়ায় নতুন শিল্পের জন্য পরিবেশ সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছে না। তার ফলে নতুন শিল্পের জন্য ছাড়পত্রই দেওয়া যাচ্ছে না। এ দিকে রাজ্য সরকার হলদিয়াকে বিনিয়োগের অন্যতম গন্তব্যস্থল হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। যা দেখে শিল্পমহল মনে করছে, রাজ্যে শিল্পায়ন করতে গেলে কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতে গেলে চলবে না। বরং রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকলেও সমন্বয় রেখে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। যেমনটা নরেন্দ্র মোদী করে থাকেন। কংগ্রেসের রাজনীতির বিরোধিতা করলেও গুজরাতে শিল্পায়নের জন্য তিনি মনমোহন সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলেন।
সোমবারের শিল্পপতি সম্মেলনে কাদের ডাকা হবে, কোথায় এই সম্মেলন হবে, তা নিয়েও যথেষ্ট জলঘোলা হয়েছে। প্রথমে ঠিক ছিল, বৈঠকটি প্রগতি ময়দানে হবে। তার পরে রাজ্য সরকারের মনে হয়, প্রগতি ময়দানের বিরাট প্রেক্ষাগৃহে যথেষ্ট ভিড় না হলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। তাই দিল্লিতে রাজ্য সরকারের নতুন অতিথিশালায় বৈঠকটি করার সিদ্ধান্ত হয়। পার্থবাবু জানিয়েছেন, সব মিলিয়ে ৩৮ থেকে ৪০ জন শিল্পপতি আগামিকালের সম্মেলনে হাজির থাকবেন।
সম্মেলনে কাঁরা থাকবেন, তা নিয়েও বিতর্ক দানা বেঁধেছে। আমন্ত্রিতদের অনেকেই কলকাতার ব্যবসায়ী। দিল্লির যে সব বিনিয়োগকারী দেশের প্রথম একশো শিল্পপতির তালিকায় রয়েছেন, তাঁরা অনেকেই ডাক পাননি। অথচ রাজ্যে বিনিয়োগের স্বার্থে তাঁদের ডাকা উচিত ছিল বলে মনে করছেন শিল্পমহল এবং সরকারি কর্তাদের একাংশ। তালিকায় অনাবাসী শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের নাম নেই। টাটা গোষ্ঠীর নতুন চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রির সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে রাজ্য সরকার। কিন্তু তিনি তো বটেই টাটা গোষ্ঠীরই কেউ আমন্ত্রিতের তালিকায় নেই! যেমন নেই অম্বানী গোষ্ঠীর কেউ। ডিএলএফ-এর রাজীব সিংহ, জিন্দল গোষ্ঠীর নবীন জিন্দল, হিন্দুস্থান মোটর্স-এর সি কে বিড়লা, ওবেরয় গোষ্ঠীর পি এস ওবেরয়-সহ একাধিক প্রথম সারির শিল্পপতি বাদ এই সম্মেলন থেকে। বাদ গিয়েছেন দিল্লিতে নিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের আমলারাও! আবার ভারতী গোষ্ঠীর প্রধান রাজন মিত্তলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যা দেখে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির কটাক্ষ, “খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতায় সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল তৃণমূল। কিন্তু ওয়ালমার্টের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা ভারতী সংস্থার কর্ণধারকেই মুখ্যমন্ত্রী ঘটা করে ডেকে আনছেন! তিনি কি তা হলে পশ্চিমবঙ্গে ওয়ালমার্টকে স্বাগত জানাতে চাইছেন?” দীপার ব্যাখ্যা, আসলে এফডিআইয়ের বিরোধিতা করে মমতার নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। সেই ভাবমূর্তি বদলাতেই এই উদ্যোগ। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছেন ডালমিয়া গোষ্ঠীর পুনিত ডালমিয়া, এইচএসবিসি ব্যাঙ্কের কান্ট্রি হেড নৈনালাল কিদোয়াই, সিআইআই-এর চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অনেকে।
এই বৈঠক ঘিরে তৃণমূলের অন্দরেও সমস্যা কম নেই।
দীর্ঘদিন ধরে দিল্লিতে শিল্পমহলের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের কাজ করে এসেছেন দীনেশ ত্রিবেদী। কিন্তু আগামিকাল তাঁকেই ডাকা হয়নি! তৃণমূল সূত্রের খবর, এতে দীনেশ ক্ষুব্ধ। তাই আজ দিল্লিতে থাকলেও তিনি আগামিকাল মুম্বইতে রশিদ খান-এর সঙ্গীতানুষ্ঠান শুনতে চলে যাচ্ছেন! আবার কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব ছাড়ার পরে রাজ্যে শিল্প দফতরের উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছিল যাঁকে, সেই সৌগত রায়কেও এই অনুষ্ঠানে ডাকা হয়নি। এমনকী তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে কোনও আলোচনাও করা হয়নি বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। যে কারণে সৌগতবাবু আগামিকাল সংসদে উপস্থিত থাকলেও এই অনুষ্ঠানে যাবেন না। বৈঠক পরিচালনা করবেন দলের রাজ্যসভা সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। যা নিয়ে
তৃণমূলের একাংশের মধ্যেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। |