জঙ্গলমহলে সমস্যার শিকড়ের সন্ধানে এক সরকারি অফিসার।
মাওবাদী অধ্যুষিত পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক হিসেবে ১৪ মাস কাটানোর অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে কলম ধরেছেন চন্দন সিন্হা। বর্তমানে তিনি রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সচিব।
‘কিন্ডলিং অফ অ্যান ইনসারেকশন নোটস ফ্রম জঙ্গলমহল’। এই বইয়েই চন্দন লিখেছেন: পঞ্চায়েত সদস্য,
|
চন্দন সিন্হা |
ঠিকাদার, সরকারি অফিসার— জঙ্গলমহল জুড়ে এই স্বার্থ-চক্রই আদিবাসী আর উন্নয়নের মধ্যে পাঁচিল হয়ে থেকেছে। সেই ছিদ্রপথেই জাঁকিয়ে বসেছে জঙ্গিপনা। হাজার হাজার নিরাপত্তা রক্ষীর উপস্থিতিতে সেখানে আপাতত শান্তি এলেও সত্যিই অশান্তির আগুন নিভেছে কি না, প্রশ্ন তুলে তাঁর আশঙ্কা কে বলতে পারে, ছাইচাপা আগুন অচিরেই আবার জ্বালিয়ে দেবে না এ রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তকে!
ক্ষমতার অলিন্দে ফিসফিসিয়ে অনেকেরই আশঙ্কা, কর্মরত অবস্থায় এ রকম বিতর্কিত কথাবার্তা লিখে বিপদ ডেকে আনতে পারেন ওই সরকারি অফিসার। চন্দনবাবু অবশ্য বলেছেন, “যা বলার বইয়েই লিখে দিয়েছি। তার বাইরে আমার কিছু বলার নেই।” কিন্তু বইয়ের মুখবন্ধে তিনি নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন। লিখেছেন, “গতানুগতিক ব্যবস্থায় আমার এই বক্তব্যগুলো অনেকেরই হয়তো ভাল লাগবে না। কিন্তু সত্য প্রকাশের স্বার্থে আমাকে এটুকু ঝুঁকি নিতেই হচ্ছে।” সেই ঝুঁকি নিয়েই চন্দনবাবু যা লিখেছেন, তাতে জঙ্গলমহলের উন্নয়নে বামফ্রন্ট সরকারের ব্যর্থতার ছবি উঠে এসেছে। পাশাপাশি, বর্তমান সরকার যে ভাবে জঙ্গলমহলে অশান্তি মুছে গিয়েছে বলে দাবি করছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
কর্মরত ওই অফিসারের বইয়ের বিষয়বস্তুর সঙ্গে একমত রাজ্যের বর্তমান পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “চন্দন সিন্হা ১০০ শতাংশ ঠিক কথা লিখেছেন। বছরের পর বছর ধরে উন্নয়নের টাকা সিপিএম লোপাট করেছে। জেলাশাসক হিসেবে যা দেখেছেন, তা লিখেছেন। এর মধ্যে অন্যায় কোথায়? এখন কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারছি, জঙ্গলমহলের দিকে ঘুরেও তাকায়নি সিপিএম। তার জন্যই এত রক্ত ঝরেছে সেখানে।” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র তথা প্রাক্তন পঞ্চায়েত মন্ত্রী বলেন, “বইটি আমি পড়িনি। ফলে এখনই উনি যা লিখেছেন, তা নিয়ে মন্তব্য করব না।” ২০০৪ সালের মার্চ মাসে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক হিসাবে যোগ দেন চন্দনবাবু। তার ঠিক তিন মাসের মাথায়, ১০ জুন আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা দেশ জুড়ে হইচই ফেলে দেয়। আমলাশোলের ঘটনার বর্ণনায় ওই আইএএস অফিসার লিখেছেন, “সে দিন সকালেই মুখ্যসচিবের টেলিফোন পেলাম। শুনলাম, একটি বহুল প্রচারিত বাংলা কাগজে আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে। তা নিয়ে মহাকরণে রিপোর্ট দিতে হবে। আমলাশোল যাওয়ার রাস্তাতেই টের পেলাম কী অসহায় অবস্থায় এখানকার মানুষ বসবাস করেন। এঁদের দুদর্শা ঘোচাতে সরকার কোনও চেষ্টা করেছে বলে মনে হয়নি।” আমলাশোলকে যে তাঁর কালাহান্ডিই মনে হয়েছিল, সে কথাও চন্দন লিখেছেন বইতে।
তখন থেকেই জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে নিয়ম করে যাওয়া শুরু করেন চন্দন। পরবর্তী ১৪ মাস জেলার বিভিন্ন প্রান্তে লাগাতার পরিদর্শনের ধারাবিবরণীই বইতে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। ৪০টি অধ্যায়ে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা, সমস্যা, ক্ষোভ অনুন্নয়ন-উন্নয়ন চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বইটিতে। সে সময় এই পরিদর্শনের ভিত্তিতে মহাকরণে পাঠানো রিপোর্ট, তা নিয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং অনুন্নয়নের ঢাল সামনে রেখে জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের অনুপ্রবেশ নিয়েও বিশদ বিবরণ দিয়েছেন লেখক।
জঙ্গলমহলের অনুন্নয়নের জন্য মূলত ভেঙে পড়া পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন চন্দনবাবু। লিখেছেন, “পঞ্চায়েতের মাতব্বরদের কাট-মানি না দিয়ে এই তল্লাটে কোনও উন্নয়নমূলক কাজ হয় না। ২০ থেকে ৪০ শতাংশ টাকা কাট-মানি হিসাবেই চলে যায় পঞ্চায়েত কর্তাদের পকেটে। ইন্দিরা আবাসের মতো প্রকল্পে আবার ৫০ শতাংশ টাকাই কাটমানি দিতে হত। আদিবাসীরাও এর থেকে ছাড় পেতেন না।”
বইয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার তালিকা আরও দীর্ঘ কোনও পঞ্চায়েত অফিস নিয়মিত খোলা থাকত না। বিরোধী পঞ্চায়েতগুলিকে উন্নয়নের টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্ব হত। পঞ্চায়েত সমিতি শাসক দলের আর গ্রাম পঞ্চায়েত বিরোধী দলের হলে তো টাকা দেওয়াই হত না বলে তাঁর দাবি।
আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়গ্রাম মহকুমায় ঠিকাদারদের প্রায় কেউই আদিবাসী নন দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন চন্দনবাবু। পঞ্চায়েত কর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশের জেরে বাইরে থেকে এসে কাজ করার নামে এরা উন্নয়নের টাকা লোপাট করেছে বছরের পর বছর। সরকারি ওই অফিসারের আক্ষেপ, “পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গলদের ফাঁকেই মাওবাদীরা ঢুকে পড়ছিল জঙ্গলমহলে।” সে কথা যে তিনি বারবার সরকারকে জানিয়েছিলেন, বইতে তারও উল্লেখ রয়েছে।
মুখবন্ধে চন্দনবাবু লিখেছেন, “আদিবাসী গ্রামগুলি ঘুরে এসে তিনি তার বিবরণ দিয়ে মহাকরণে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। তা পড়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর চোখে জল এসে যায়। মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক অফিসারই তাঁকে সে কথা জানান।” তাঁর দাবি, সরকার দুর্দশা দূর করার চেষ্টা করলে হয়তো ২০০৮-এর ২ নভেম্বর বুদ্ধদেববাবুকে মাইন বিস্ফোরণের মুখে পড়তে হত না। পরের সাত মাস লালগড় মুক্তাঞ্চল হত না। ২০০৫-এ পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে অন্যত্র বদলি হন চন্দনবাবু। পরের কয়েক বছরে সেখানে জঙ্গি আন্দোলন ঠেকাতে সরকারি তৎপরতা বেড়েছে। হয়তো শান্তিও ফিরেছে কিছুটা। কিন্তু বইতে ওই শান্তিকেও কার্যত ভ্রম বলে বর্ণনা করেছেন ওই সরকারি অফিসার। প্রশ্ন তুলেছেন, “আদিবাসীদের অবস্থা কি সত্যিই বদলেছে?” হয়তো প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন নিজেই। লিখেছেন, “জঙ্গলের আগুন হয়তো সাময়িক ভাবে প্রশমিত হয়েছে। তবে সে আগুন এখন ছাইচাপা!” |