|
|
|
|
আমার যেমন জমি তেমনই রবে... |
পুরনো ধারণা আঁকড়ে চলবেন, শিল্প চাইলেও অনড় মুখ্যমন্ত্রী |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
মুখে বলছেন শিল্প চাই, কিন্তু কাজে আঁকড়ে থাকছেন পুরনো ধ্যানধারণা শনিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সময় কাটিয়ে এমনটাই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া রাজধানীর শিল্পমহলের।
তবে আজ বণিকসভা ফিকি-র শীর্ষ সম্মেলনে সপারিষদ হাজির হয়ে শিল্পপতিদের কাছে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের জন্য যে ভাবে আহ্বান জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, তাকে মন্দের ভাল বলেই মনে করছেন শিল্পপতিরা। যদিও শিল্পের জন্য জমি কোথা থেকে আসবে, জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের গেরো কী ভাবে কাটবে, সেই প্রশ্নের জবাব এ দিনও তাঁরা পাননি। উল্টে সভার পরে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সংস্কার নীতির বিরোধিতা থেকে সরে না-আসার ইঙ্গিত দিয়ে মমতা বলেছেন, পুরনো ধ্যানধারণা নিয়ে তিনি আমজনতার সঙ্গেই থাকতে চান।
আজ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার আগে ফিকি-র বিদায়ী সভাপতি রাজ্যবর্ধন কানোরিয়া বলেন, “শিল্পায়নের জন্য আরও জমি প্রয়োজন। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানতে গেলে কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে হবে। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র পথ হল, কৃষি ও শিল্প, দু’টোতেই একসঙ্গে জোর দেওয়া।” পরে শিল্পপতি শ্রীবর্ধন গোয়েন্কা জমি নীতি নিয়ে মমতাকে প্রশ্ন করেন। যার উত্তরে মমতা ফের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, শিল্পের জন্য তাঁর সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে না। ল্যান্ড ব্যাঙ্কের জমি রয়েছে। না হলে শিল্পপতিদেরই জমি কিনে নিতে হবে। |
|
|
|
|
মঞ্চে নানা মুহূর্ত। বণিকসভা ফিকি-র ৮৫তম বার্ষিক
সাধারণ সভায় মুখ্যমন্ত্রী। শনিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই |
|
একে রাজ্যের ল্যান্ড ব্যাঙ্কে এক লপ্তে জমি নেই, তার উপর জমি বহু মালিকানায় বিভক্ত হওয়ায় সরাসরি জমি কেনা কঠিন বলেই শিল্পপতিদের মত। এমনকী, কাটোয়ায় এনটিপিসি-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাও এই পথে হাঁটতে রাজি হয়নি। মমতা অবশ্য নিজের অবস্থানে অনড়। আজ তিনি বলেন, “কখনও কখনও লোকে বলে জমি অধিগ্রহণ করো, গুলি চালাও, তার পর শিল্প গড়ো। এমন অস্থিরতার মধ্যে শিল্প গড়া যায় না। শান্তিপূর্ণ ভাবে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহাবস্থানের ভিত্তিতেই শিল্প গড়া সম্ভব।”
মমতার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “জমির প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী যে সিদ্ধান্তে অটল, তাতে শিল্প আসা মুশকিল। জমি ব্যাঙ্ক নিয়ে কোনও প্রোজেক্ট রিপোর্ট সরকার দিতে পারেনি। ফলে শিল্পপতিরা কেন আসবেন?”
শিল্পমহলের একাংশ অবশ্য বলছে, জমি একটা বড় বিষয় হলেও রাজ্যের আসল সমস্যা হল ভাবমূর্তির। লগ্নিকারীরা সেখানে যেতে ভরসা পান না। ভারত চেম্বার অফ কমার্সের প্রাক্তন সভাপতি পবন পোদ্দারের কথায়, “শিল্পায়নে মূল অন্তরায় হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের ধ্যানধারণা। একটা বড় বিনিয়োগ তা বদলে দিতে পারে।”
শিল্পমহলের সামনে রাজ্যকে তুলে ধরার চেষ্টায় মমতা আজ বলেন, “আমাদের লোকেদের মেধা খুব ভাল। নাসা থেকে ভাষা, কম্পিউটার থেকে কম্পাউন্ডার, সর্বত্র আমাদের মেধা কাজ করে। এটাকে কাজে লাগাতে চাইলে রাজ্যে লগ্নি করুন, ভয় পাবেন না। রাজ্যে শ্রমিক সস্তায় পাওয়া যায়। আগে যে রকম কারখানা বন্ধ হয়ে যেত বা ধর্মঘট হত, আমরা তা হতে দিচ্ছি না।”
এই আশ্বাসে তাঁরা কতটা আশ্বস্ত হলেন, তার একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে সোমবার। সে দিনই দিল্লিতে বেশ কয়েক জন শিল্পপতির সঙ্গে একান্ত বৈঠক করবেন মমতা। ভারতী সংস্থার প্রধান রাজন মিত্তলের মতো শিল্পপতিরা সে দিন সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর সামনে রাজ্যে বিনিয়োগের প্রস্তাব রাখবেন বলে শিল্প মহল সূত্রের খবর। এবং সুনির্দিষ্ট জবাব পাওয়ারও আশা করছেন তাঁরা।
তবে মমতা সে দিন যা-ই বলুন, নিজের অবস্থান থেকে সরে আসুন বা না-আসুন, আজ দিল্লিতে ফিকি-র সদর দফতরে বার্ষিক সাধারণ সভায় তাঁর যোগদানকে খানিকটা হলেও ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে শিল্পমহল। নভেম্বরে কলকাতায় ফিকি-র সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী তো দূরের কথা, রাজ্যের কোনও মন্ত্রীও হাজির ছিলেন না। আজ কিন্তু দুই মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অমিত মিত্র, মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনকে (মুুখ্যমন্ত্রীর ভাষায়, তাঁর সরকারি পরিবার) সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মমতা। যাকে রাজ্যে শিল্পায়নে তাঁর সদিচ্ছার প্রকাশ বলে মনে করছেন অনেক শিল্পপতি।
|
পঞ্চবাণ |
বেসরকারি শিল্পের জন্য জোর করে জমি অধিগ্রহণ করব না।
২০ মে ২০১১
শপথগ্রহণের পরে |
জমি কিনে নিতে হবে শিল্পপতিদেরই।
১৮ জুন ২০১১
শিল্পপতিদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে |
জমি সমস্যা হবে না। সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেই সহযোগিতার চেষ্টা করব।
১৭ অক্টোবর ২০১১
শিল্পপতিদের বিজয়া সম্মিলনীতে |
জমি কিনতে দালাল ধরবেন না। ল্যান্ড ব্যাঙ্ক থেকে সরকারই জমি দেবে।
১০ নভেম্বর ২০১২
শিল্পপতিদের বিজয়া সম্মিলনীতে |
রাজ্যের জমি-নীতি স্পষ্ট। লগ্নিকারীদের সরাসরিই জমি কিনতে হবে।
১৪ নভেম্বর ২০১২
তরুণ শিল্পপতিদের সভায় |
|
কিন্তু শুধু সদিচ্ছা দেখালেই যে শিল্পপতিরা বিনিয়োগের ঝুলি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ছুটে যাবেন না, সেটাও এক নিঃশ্বাসে বলছে শিল্পমহল। তারা মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানে পরিবর্তন চায়। কিন্তু আজ মমতার বক্তব্য শুনে শিল্পমহলের একটা বড় অংশেরই মত হল, এর আগে কলকাতায় শিল্পপতিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে বা খড়গপুর আইআইটি-র প্রাক্তনীদের সম্মেলনে যা বলেছেন, আজ তার বাইরে নতুন কিছু বলেননি।
শিল্পমহল মনে করছে, সমস্যার কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি ই-মেল করলেই তিনি সব সমাধান করে দেবেন, এই শুকনো আশ্বাসে বিনিয়োগের চিঁড়ে ভেজার নয়। শিল্পপতি বালকৃষ্ণ ডালমিয়া বলছেন, “ওঁর সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় নেই। তবে নানা সমস্যায় ঘেরাও হয়ে রয়েছেন।” এর বেশি কড়া কথা অবশ্য কেউই এখন প্রকাশ্যে বলতে চাইছেন না।
শুধু রাজ্যে বিনিয়োগের প্রশ্নে নয়। জাতীয় স্তরেও মমতার বিরোধিতায় খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ এত দিন আটকে ছিল। পেনশন-ব্যাঙ্ক বিলেও তৃণমূল বিরোধিতা করছে। পণ্য-পরিষেবা কর চালু করার ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকারের বাধা রয়েছে। আজ কানোরিয়া সে প্রসঙ্গও তুলেছিলেন। অনেকেরই আশা ছিল, মুখ্যমন্ত্রী নিজে না হলেও, ফিকি-র প্রাক্তন মহাসচিব, বর্তমানে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এর জবাব দেবেন। সেই আশা পূরণ হয়নি। তৃণমূল সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, নীতিগত ভাবে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতা করলেও সোমবারের শিল্প সম্মেলনে কিন্তু রাজন মিত্তলও আমন্ত্রিত। যাঁর সংস্থা ভারতী এ দেশে ওয়ালমার্টের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে।
এ দিনও মমতা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জানিয়েছেন, তিনি ‘হার্ভার্ড ইংলিশ’ জানেন না। নেতিবাচক প্রচারের জবাব দিতে নিজস্ব কোনও টিভি চ্যানেলও তাঁর নেই। রাজ্য সরকারের ‘গঠনমূলক পদক্ষেপ’-এর প্রশংসা না-করা হলে তাঁরা কোথা থেকে উৎসাহ পাবেন, এই অনুযোগও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মমতার এই খোলা মনে কথাবার্তার প্রশংসা করেছেন ফিকি-র সদ্য নির্বাচিত সভানেত্রী, এইচএসবিসি-র কান্ট্রিহেড নয়না লাল কিদোয়াই। রাজ্যে পর্যটনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ টানতে এবং বস্ত্র শিল্পকে ঘুরে দাঁড় করাতে ফিকি সাহায্য করবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কানোরিয়া বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে নতুন জমানায় কর্মসংস্কৃতি ফিরেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, বন্ধ-ধর্মঘট কমে যাওয়ায় শ্রমদিবসও অনেক কম নষ্ট হচ্ছে। এ বার শিল্পায়নের মূল প্রশ্নে মমতা কী মনোভাব নিচ্ছেন, সোমবারের বৈঠকে সেটাই দেখতে চাইছেন সকলে। |
|
|
|
|
|