|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
সংযত, তবে অপ্রিয়ভাষণে সংবৃত নন |
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় |
মুক্তিযুদ্ধ তারপর: একটি নির্দলীয় ইতিহাস, গোলাম মুরশিদ। প্রথমা প্রকাশন (ঢাকা), ৪০০.০০ |
১৯৪৭-এ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, তারপর শেখ মুজিব-হত্যা (১৯৭৫) এবং সামরিক-প্রশাসনিক ক্ষমতাদ্বন্দ্ব প্রায় তিরিশ বছরের টানা ইতিহাস পর্বে-পর্বে বিভক্ত। পশ্চিমবঙ্গে তো নয়ই, বাংলাদেশেও সম্ভবত এমন বই আগে লেখা হয়নি। বইটির শেষে উল্লিখিত গ্রন্থপঞ্জি থেকেও সেই ধারণাই হয়। শূন্যস্থান পূরণ করে গোলাম মুরশিদ নিঃসন্দেহে একটা বিরাট কাজ করেছেন। মুরশিদ লেখেন অতি সরল, প্রাঞ্জল ভাষায়, বিশ্লেষণে তাত্ত্বিক জটিলতা থাকে না; কিন্তু তথ্যের বিন্যাস থেকেই একটা যুক্তিক্রম উঠে আসে। তাঁর মন্তব্যগুলি সংযত, কিন্তু স্পষ্টবাদী। এটিও সেই গোত্রের তথ্যসমৃদ্ধ, বিবরণধর্মী।
এ রকম কোনও বই না থাকায় আমাদের অনেক সময় অসুবিধে হত; যেমন আখতারুজ্জমান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই পড়তে গিয়ে। বুঝি, এটা আইয়ুব-বিরোধী জন-অভ্যুত্থানের সময় (১৯৬৯); কিন্তু ইতিহাসটা ভাল করে জানি না। মুরশিদ প্রতিটি তথ্য যাচাই করে কালক্রমিক একটি ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তাঁর রচনা সংযত, কিন্তু অপ্রিয়-ভাষণের ক্ষেত্রে সংবৃত নয়।
প্রথম পঁচিশ বছরের বিবরণ পড়তে গিয়ে স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গের তুলনা মনে এসে যায়। এই বঙ্গে প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও কংগ্রেস টানা কুড়ি বছর রাজত্ব করেছিল। ওপার বাংলায় কিন্তু বারবার সরকার বদল হয়েছে; ১৯৫৮-য় জারি হয়েছে ফৌজি শাসন। অন্য দিকে, পাকিস্তান-দাবির জন্মদাতা মুসলিম লিগ প্রায় নিশ্চিহ্ন। মুজিবুর রহমান, এমনকী বহুনিন্দিত সোহরাবর্দিরও রাজনৈতিক অবস্থান বদলেছে। সোহরাবর্দির নেতৃত্বকালেই ‘আওয়ামী মুসলিম লিগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটা ছেঁটে দেওয়া হয় (পৃ. ৫৩)। বাংলা ভাষাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
মুরশিদের বর্ণনায় কোথাও আবেগের অতিরেক নেই। মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের কথা তিনি সবিস্তার লিখেছেন (পৃ.১৩৭-৪৬); তেমনই গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন ভারতের ভূমিকা, ইন্দিরা গাঁধীর রাজনীতি (পৃ.১৩৩-৩৪), ভারতের সামরিক সাহায্য, শরণার্থীদের আশ্রয়দান, ত্রাণে বিভিন্ন দেশ ও সংগঠনের সহায়তা সবই। পরিষ্কার লিখেছেন, নভেম্বর (১৯৭১) মাস থেকে ভারত পাকিস্তানকে যুদ্ধে প্ররোচিত করলেও তেসরা ডিসেম্বরের আগে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেনি (পৃ.১৪২-৪৩)। তাঁর দ্ব্যর্থহীন মন্তব্য: ‘ভারতের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে অতো দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না’ (পৃ.১৪৭)। অন্য দিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে ভারত যে কিছু গোলমাল করে ফেলেছিল, সে কথাও উল্লেখ করেছেন (পৃ.১০৬); স্বাধীন বাংলাদেশে কেন একটা ভারত-বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠল, ব্যাখ্যা করেছেন তার কারণও (পৃ.১৯৭-৯৮)।
গোলাম মুরশিদ লেখেননি, কিন্তু আমরা জানি, সেই সময় পশ্চিমবঙ্গেও অতি-বামপন্থীরা প্রচার করছিলেন ভারত বাংলাদেশকে গিলে নেবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চিনের জঘন্য ভূমিকার কথাও মুরশিদ উল্লেখ করেছেন (পৃ.১১১)। তিনি ঠিকই লিখেছেন, চিনভক্ত নকশালপন্থীরাও মুক্তিযুদ্ধকে বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্ব বলে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। এ সব আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।
১৯৭১-এ বনগাঁ-র শরণার্থী শিবিরে গিয়ে শুনেছি, পাক সেনারা বেছে-বেছে হিন্দুদের ওপর বেশি নির্যাতন করেছে। পরে সেই রকম চলে-আসা দুই শিক্ষক-সহকর্মীর মুখেও একই কথা শুনি। তারও পরে নিশ্চিত হই বিদেশি সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাসের বই পড়ে। গোলাম মুরশিদ ‘খানসেনাদের’ অকথ্য অত্যাচার, নারীধর্ষণ, নির্বিচার হত্যা প্রসঙ্গে হিন্দুদের ওপর দ্বিগুণ অত্যাচারের কথা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, সঙ্গে দিয়েছেন অর্থবোধক একটি ছবিও (পৃ.৮২-৮৫)। ১৯৭১-এ কলকাতা থেকে অনেক পুস্তিকা, প্রচারপত্র বেরিয়েছিল, অজস্র কবিতা লিখেছিলেন কবিরা; কিন্তু এই প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়নি। (spurious) সেকুলারিজম আমাদের শিখিয়েছে, এ-সব কথা বলতে হয় না। মুরশিদ তার বাইরে থাকতে পেরেছেন।
আবেগের আতিশয্যমুক্ত ভাষায় মুজিব-হত্যার ঘটনাটি মুরশিদ যে ভাবে বর্ণনা করেছেন (পৃ.২১৮-২১), তা পড়লে সত্যিই কষ্ট হয়। এক দিনেরও বেশি বাড়ির সিঁড়িতে পড়ে থাকায় দেহটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ‘বঙ্গবন্ধু’-র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিয়েও মুরশিদ দেখিয়েছেন, মন্ত্রিসভা গঠনের সময় তিনি ঠিক লোককে নির্বাচন করেননি অনেকেই ছিল সুবিধাবাদী; মুজিব-পরিবারের লোকেরাও দুর্নীতিতে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল (পৃ.১৮৫-৮৬)। এ রকম নিঃসংস্কার দৃষ্টিভঙ্গি বড় একটা দেখা যায় না।
মুরশিদ তাঁর বইটির নাম দিয়েছেন ‘নির্দলীয়’ ইতিহাস। ‘নিরপেক্ষ’ লিখলেই বোধহয় ভাল হত; অবশ্য নিরপেক্ষ ইতিহাস আদৌ হয় কি না, তাও একটা প্রশ্ন। মুরশিদ কয়েকবারই (পৃ.৫৩, ৫৭) পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দুদের চলে আসা, ১৯৫০ ও ১৯৬৪-র দাঙ্গা ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেন হিন্দুরা চলে আসছিলেন, সে বিষয়ে লেখক প্রায় নীরব। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক বৃদ্ধার কথা লিখেছেন। আশি মাইল পথ হেঁটে তিনি যখন সল্ট লেকের শরণার্থী শিবিরে পৌঁছলেন, তাঁর আশ্রয় হল ‘একেবারে স্বর্গে’ (পৃ.৯৯-১০০)। এ রকম ঘটনা কিন্তু ১৯৫০-এও ঘটেছিল। যুদ্ধ নয়, সাম্প্রদায়িক হিংসাই এই ভাবে স্বর্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল কিছু শরণার্থীকে।
স্বাধীন বাংলাদেশ খুব বেশি দিন সেকুলার থাকতে পারেনি। এর বীজ শুধু মৌলবাদী নয়, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক কিছু বুদ্ধিজীবীর মধ্যেও ছিল। সৈয়দ আলী আহসানের যখন সময় এল (ঢাকা, ১৯৯২, পৃ.১৩৫-৩৭) বইটি পড়লেই তার আভাস পাওয়া যায়। |
|
|
|
|
|