|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
কারাগারেও তিনি পরিব্রাজক |
প্রদীপ বসু |
বিয়াল্লিশের বাংলা, নির্মলকুমার বসু। কারিগর, ৪০০.০০ |
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৪২ সালে নির্মলকুমার বসু কারারুদ্ধ হন। দমদম সেন্ট্রাল জেলে অগস্ট ১৯৪২ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ পর্যন্ত থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের সহবন্দি মানুষদের থেকে অবিভক্ত বাংলার জেলাভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। বিয়াল্লিশের বাংলা সেই তথ্যসংগ্রহের ফসল। নতুন সংস্করণে মূল বইটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর স্বাধীনতা-উত্তর মূল্যায়ন ‘আধুনিক বঙ্গদেশ’, এটি আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতামালার বঙ্গানুবাদ। রয়েছে আরও দু’টি মূল্যবান রচনা: একটি গৌতম ভদ্রের ‘বিয়াল্লিশের বাংলা: ফিরে পড়ার অভিজ্ঞতা’ এবং অন্যটি নির্মলকুমারের ‘জেলের ডায়েরি’কে ভিত্তি করে অভীককুমার দে’র লেখা ‘নির্মলকুমার বসু: কেয়ার অফ দমদম জেল’। ‘বিয়াল্লিশের বাংলা’ প্রথমে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয় বিনয়কৃষ্ণ দত্তের ‘দর্শক’ পত্রিকায় (১৯৬১-’৬৩), পরে গ্রন্থাকারে (১৩৭৮ বঙ্গাব্দে)।
নির্মলকুমারের আত্মপরিচিতিতে ‘পরিব্রাজক’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে, নিজেকে পরিব্রাজক হিসেবে ভাবতেই তিনি ভালবাসতেন, নৃতত্ত্বচর্চাও করেছেন পরিব্রাজক রূপে। এই বইটি রচনাকালে তাঁর অবস্থান কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত, এখানে তিনি কারারুদ্ধ, চার দেওয়ালে আবদ্ধ। বস্তুত এটি একটি কারা-নিবন্ধ। কিন্তু এখানেও তিনি অবিভক্ত বাংলা পরিব্রাজনা করেছেন সহবন্দিদের মাধ্যমে। বন্দি হয়ে জেলে যাওয়ার সময়ও তিনি যেন পরিব্রাজকই রয়ে গেছেন। ডায়েরিতে লিখেছেন: ‘বাড়ি থেকে সরকারি গাড়ি চড়ে চলেছি। সঙ্গে নিত্যব্যবহার্য সামান্য দু-চারখানি জিনিস নিতে পেরেছি মাত্র। যেমন জিনিস নিয়ে ভারতবর্ষের তীর্থ হতে তীর্থান্তরে ভ্রমণ করেছি, আজও আমার সঙ্গে তার বেশি কিছু নেই।’ মধ্যযুগীয় পরিব্রাজকের মতো তিনি ছিলেন সত্যের সন্ধানী এবং সেই সত্যের প্রচারে উৎসাহী। পরিব্রাজক হিসেবে তাঁর এই সব রচনা ঠিক অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ নয়, বরং খোলামেলা বর্ণনায় এখানে তিনি পাঠককে তাঁর যাত্রা ও চিন্তার সহযাত্রী করে নেন।
এই ধরনের জেলাভিত্তিক তথ্যের গ্রন্থ তৈরি করতে গেলে প্রয়োজন একটি কাঠামো প্রস্তুত করা, যে কাঠামো নির্দিষ্ট করে দেবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির তালিকা। নির্মলকুমারের গ্রন্থেও একটা কাঠামো আছে, যা তিনি জেলার বিবরণে অনুসরণ করেছেন, লিখেছেন সেই জেলার মাটি, গাছপালা, উদ্ভিদ, নদ-নদী, চাষ, খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি, ঘরবাড়ি, শিল্প, মেলা-উৎসব, ঐতিহাসিক স্থান, পোশাক প্রভৃতির বিবরণ অনেকটা গেজেটিয়ারের ধরনে। আবার, অন্তর্ভুক্ত করেছেন এমন সব বিষয়, যেগুলির প্রতি তাঁর নিজের সারা জীবন আগ্রহ ছিল। যেমন, জাতিগত পেশা ও তার পরিবর্তন, যজমানি ব্যবস্থার রূপান্তর, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, গ্রামাঞ্চলে তেল নিষ্কাশন পদ্ধতি, সামাজিক আদান-প্রদানের খতিয়ান ইত্যাদি। বস্তুত এই বিষয়গুলি সম্পর্কে নির্মলকুমারের মন্তব্য বইটিকে শুকনো গেজেটিয়ার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। পরিব্রাজক হিসেবে নির্মলকুমারের লেখা অন্যান্য বাংলা গ্রন্থে যে বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, তার ছাপ এই বইটির মধ্যেই আছে। গৌতম ভদ্র সঠিক মন্তব্য করেছেন, ‘বিয়াল্লিশের বাংলা কেবল বিজ্ঞানভিত্তিক, ভূতবাদী নৃতত্ত্ব অনুসন্ধান, অথবা সুন্দর ভূগোল বৃত্তান্ত বা আঞ্চলিক সংস্কৃতি রচনার মডেল মাত্র নয়, বরং এক গান্ধীবাদী বুদ্ধিজীবীর লেখা রাজনৈতিক দলিলের আভাসও সেখানে ধরা পড়ে।’
গ্রামীণ ভারতে কী ভাবে তেল নিষ্কাশন হয়, নিষ্কাশন যন্ত্রের পরিবর্তনই বা কেন এবং কী ভাবে হল, এ বিষয়ে নির্মলকুমারের বিশেষ আগ্রহ ছিল। হিন্দু সমাজের গড়ন (১৩৫৬) বইতে তিনি এ বিষয়ে ছবি-সহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই বইটিতেও দেখি প্রায় প্রতিটি জেলার ক্ষেত্রে কারা তৈলকার, কী ভাবে তেল নিষ্কাশন হয়, এ বিষয়ে কিছু-না-কিছু তথ্য দিয়েছেন। কয়েকটি উদ্ধৃতি দিলে বোঝা যাবে। পাবনা জেলায় ‘হিন্দু তৈলকার নাই। সকলে মুসলমান। বলদের চোখে ঠুলি, নীচে ফুটা ও একটি বলদ’। মেদিনীপুর জেলায় ‘রামজীবনপুর অঞ্চলে ঘানির তেল খুব চলে, এ দিকে কলের তেলের চলন কম। কলুদের জল চলে না। গরুর চোখে ‘ঠুলি’, ঘানিতে এক বলদ ও ফুটা আছে। এক-আধ জন তেলি আছে তারা ফুটাবিহীন (দুই বলদ) ঘানিতে তেল করে, ন্যাকড়া দিয়া তেল তোলে’। রাজশাহি জেলায় ‘তেলের কাজ মুসলমান কলুতে করে (‘খুলু’ বলে)। অপর মুসলমান ইহাদিগকে নীচু জাতি বলিয়া গণ্য করে’। নির্মলকুমার তাঁর নিজের কৌতূহলের বিষয়টিকে সুন্দর ভাবে জেলা বিবরণে মিশিয়ে দিয়েছেন। অন্য কেউ বিষয়টিকে আদৌ জেলা বিবরণে স্থান দিতেন কি না সন্দেহ আছে। হিন্দু সমাজের জাতিপ্রথা, যজমানি ব্যবস্থা, জাতিগত পেশার পরিবর্তন এই বিষয়গুলি ছিল নির্মলকুমারের বিশেষ আগ্রহের এলাকা, একই সঙ্গে তিনি কৌতূহলী ছিলেন মুসলমানদের বৃত্তি ও তার পরিবর্তনের বিষয়েও। বইটিতে এই সব বিষয়ে নানা খুঁটিনাটি তথ্য সরবরাহ করেছেন তিনি। জাতিগত পেশা, পেশায় আঞ্চলিক পার্থক্যের নানা তথ্য দিয়েছেন তিনি, যেমন বর্ধমানের বিবরণে লিখেছেন: ‘নবদ্বীপে যেমন ঠাকুর গড়ার কাজ কুমোরে করে, এখানে তাহা নয়। ছুতারে ঠাকুর গড়ে’। যজমানি ব্যবস্থার রকমফের, কোনও জাতি জল-চল না জল-অচল, অর্থনৈতিক আদানপ্রদানের প্রকৃতি, সবই জানিয়েছেন তিনি। নতুন পেশার কথা লিখেছেন, যেমন ঢাকা জেলায় ‘বছর পনেরো হইতে মুসলমানেরা ক্রমে বর্ষায় ইলিশ মাছ ধরার কাজ এবং ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছে। পূর্বে জাত হারাইবার ভয়ে জেলের কাজ করিত না, আজকাল বেশ করে’। বাঁকুড়া জেলার আলোচনায় লিখেছেন: ‘হাটগ্রামে শাঁখারি ছাড়া ব্রাহ্মণেও শাঁখার কাজ করিতেছে। ব্রাহ্মণে তাঁতের কাজও করে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় (ছত্রী) সকলে শহরে মোহন মাড়োয়ারির সূতা রঙের কারখানাতেও অপক্ষপাত কাজ করিতেছে’। অস্পৃশ্য জাতিদের ক্ষেত্রে গাঁধীবাদীদের কাজকর্মেরও উল্লেখ করেছেন। ত্রিপুরায় ঋষিরা চামড়ার কাজকর্ম করত, কিন্তু ‘আজকাল স্বদেশী কর্মীদের চেষ্টায় মুনিষ, মাঝি, তাঁতের কাজ, লেখাপড়া শেখা, চামড়া পাকানো ও জুতা তৈরির কাজ শিখিতেছে’।
অনেক জেলার ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য আছে, যা বেশ কৌতূহল জাগায়। যেমন ত্রিপুরা জেলায় ‘মোটের উপর হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক ভাল, নারী হরণ অতি কম বলা চলে’। ‘হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক কিশোরগঞ্জে খারাপ, জামালপুরে ১৯০৮ সালে দাঙ্গা হয়’। ‘হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক সন্দীপে মোটের উপর ভাল। ‘জন্মের থেকে ধর্ম বড়’ প্রবাদের অর্থ ধর্ম মা, ধর্ম বোন, ধর্ম ভাই হইলে তাহার সঙ্গে আত্মীয়তা খুব নিবিড় হয়। হিন্দু-মুসলমান অপক্ষপাতে এই সম্বন্ধ পাতায়’। বা, সব শেষে রংপুর জেলায় ‘মুসলমানদের মধ্যে রাজবংশী মেয়েদের উপর অত্যাচার করার জন্য বছরের একটা সময় অনেক মকদ্দমা হয়’। অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক মূল্যায়ন করার এই প্রচেষ্টা কিছুটা নিশ্চয়ই সেই সময়ের বাংলার রাজনীতির টানাপড়েনের প্রভাবে, কিন্তু অনেকটাই যে নির্মলকুমারের নিজস্ব দূরদর্শিতার কারণে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।
নির্মলকুমারের ইচ্ছে ছিল এই তথ্যের ভিত্তিতে বাংলার এক সামগ্রিক চিত্র প্রস্তুত করবেন, কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি। বইটি যখন প্রকাশের সময় এল, তখন ‘দেশের পুরাতন রূপ আর নাই’। তবুও ১৯৭১-এ ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন: ‘তবু বাঙ্গালী মাত্রের নিকটে জন্মভূমি চিরকালই প্রিয় থাকিবে এই বিশ্বাসে পুস্তিকাখানি প্রকাশনের বিষয় রাজি হইয়াছি। ইহার সাহায্যে দেশকে, দেশের মাটি ও মানুষকে, তাহাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, হাট বা মেলার সম্বন্ধে যদি আমাদের অনুরাগ এবং অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায়, তাহা হইলেই শ্রম সার্থক জ্ঞান করিব’। তবে প্রথম প্রকাশের চল্লিশ বছর পর আজকের বাঙালি একই রকম অনুসন্ধিৎসা বা ভাবাবেগ দ্বারা চালিত হবে কি না, এ প্রশ্ন থেকেই যায়। |
|
|
|
|
|