|
|
|
|
|
ন্যানোর দাক্ষিণ্য |
প্রজার চোখেও রাজা সাজার স্বপ্ন
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • সানন্দ (গুজরাত) |
|
হতভাগা রাজমিস্ত্রি!
রাজবাড়ি বানানোর বরাত। তাতে দিনরাত বাবুর কিচমিচ।
রাজবাড়ির ঝুলবারান্দা কিছুতেই হচ্ছে না। তিন বার ভাঙা হল! বাবুর মন ভরে না। সকাল থেকে আতর মেখে বাড়ির মুখ চেয়ে ধুলোয় বসে থাকেন। শুধু বলেন, এ ভাবে নয়। ও ভাবে। লোকে যেন দেখে বলে, ‘লক্ষ্মণভাই আর এলে-বেলে নয়। তিনি এখন কোটিপতি’!
সিঙ্গুর থেকে মুখ ফিরিয়ে এই সানন্দেই যাত্রা শুরু টাটার ন্যানোর। এখন তার বিশাল সাম্রাজ্য। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ। বহু রঙের হাজার হাজার ন্যানো উঁকি মারছে কারখানার পাঁচিলের ও পারে। তার পাশেই অটো-হাব। মোদীর স্বপ্নের প্রকল্প।
লক্ষ্মণভাইয়ের জমি নিয়েছে মোদী সরকার। মোটা ক্ষতিপূরণ। আগে চাষ হত। রোজগার তেমন ছিল না। বেচতে চাইলেও লোক ছিল না। দাম উঠত বড়জোর বিঘা প্রতি পাঁচ লাখ। আর এখন? ন্যানো আসতেই জমির দাম হু-হু করে বেড়েছে। সরকার কিনেছে প্রায় ত্রিশ লাখ দরে। ফলে জমি গিয়েছে, কিন্তু কোটি কোটি টাকা এসেছে গাঁয়ের মানুষের ঘরে। ন্যানো কারখানার চার পাশে সিয়াওয়ারা, মোতিপুরা, হীরাপুরা, রসুলপুরা...। গ্রামের পর গ্রাম কোটিপতিদের ভিড়।
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা মোদী উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। প্রজারা এখন ‘রাজা’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। রাজার মতোই শখআহ্লাদ! গাঁয়ের কাঁচা রাস্তায় পাকা বাড়ি। কাঁড়ি কাঁড়ি দামি গাড়ি। জমি নেই। কাজ নেই। দিনভর টই টই। ‘এল’ লাগানো গাড়িতে। টাকা উড়ছে। শখ মিটছে একঝাঁক নব্য কোটিপতির।
ব্যতিক্রমও আছে। যেমন রসুলপুরা গ্রামের আশরফ খান। দাদা হাবিব খান। বিজেপির সংখ্যালঘু সেলের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভবিষ্যৎ বুঝে নিয়েছেন। দুই ভাইয়ের বারো বিঘা জমি। রাতারাতি প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা আমদানি। টাকা পেয়েই দেড়শো কিলোমিটার দূরে সস্তায় নতুন জমি কিনে ফেলেছেন। আমদাবাদে একটি ফ্ল্যাট। বাকিটা ব্যাঙ্কে। বললেন, “জমি নেই। টাকা ফুরোলেই জমিহীন শ্রমিক! স্রেফ আয়েসে মেতে লাভ নেই।”
কোটিপতিরাই এখন দু’দলের পথিক। কেউ মজেছেন টাকার বিলাসে। কেউ সঞ্চয়ের হাত ধরে ভবিষ্যতে স্বচ্ছলতার খোঁজে। আরও একটি দল আছে। যাঁদের স্বপ্নপূরণ বাকি। তাঁরা রয়েছেন সেই তিমিরেই। যাঁদের জমি ছিল না। ফলে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নও বৃথা। ঈর্ষা হয়। আক্ষেপও। তাঁদের ভবিষ্যৎ কী? ন্যানো কারখানার সবথেকে কাছের গ্রাম ছাড়োড়ি। সে গ্রামের সরপঞ্চ প্রবীণ পরমার। বললেন, “কোটিপতিরা তো এখন আর কারখানায় কাজ করতে চায় না। বাকিরা তো চায়। কিন্তু কারখানায় বেশির ভাগ তো বাইরে থেকে কর্মী আসছে। আমাদের গাঁয়ের লোকেদের কাজ কোথায়?”
ভোট বাজারে এই নিয়ে চাপা অসন্তোষ রয়েইছে। বিরোধীরা সেই আগুনে হাওয়াও দিচ্ছে। আর মোদী বোঝাচ্ছেন, সবে তো শুরু। বড় কারখানা সব আসুক। সঙ্গে আরও ছোট-মাঝারি। নতুন নতুন পরিকাঠামো। আবাসন। স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-বাজার। হরেক রকম সুযোগ। কাজের সম্ভার। স্বপ্ন দেখছেন ‘নেই’ রাজ্যের সদস্যরাও। বুক বাঁধছেন আশায়। তাঁদের অনেকে এখন থেকেই দোকান খুলেছেন। ভিন রাজ্য মায় ভিনদেশী অতিথিরাও আসছেন। তাঁদের রোজকার চাহিদাও কম নয়। আর এক সঙ্গে কয়েক হাজার হেক্টরের ভোল যখন বদলে যাবে, তখন? উন্নয়নের সুফল তো চুঁইয়ে পড়বে।
সানন্দ। মোদীর উন্নয়নের মশাল। গোটা দেশ-দুনিয়ায় মোদীর উন্নয়নের তুরুপের তাস। তার জোরেই তৃতীয় বারের ভোটভিক্ষা। রোজ চোখের সামনে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে চেনা গ্রামের ছবিটি। এক দিন বদলে যাবে ভাগ্যের দিশাও। মুঠো ভরে স্বপ্ন আঁকড়ে দিন গুনছে সানন্দ। |
|
|
|
|
|