দশ বছর আগের সেই দুলালও নেই, নেই সেই দমদমও। তবু বন্দি-অভিনেতা দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে দমদম এবং পাইকপাড়ার ত্রিসীমানায় হাজির করাতে চায় না প্রশাসন!
বন্দিজীবনের দশ বছর পরে নাটক ‘রাজদর্শন’-এর হাত ধরে স্ব-ভূমিতে ফেরার সুযোগ এসেছিল দুলালবাবুর কাছে। কিন্তু সেই সুযোগে দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পাইকপাড়ার মোহিত মৈত্র মঞ্চের রাজদর্শনের শোয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না তাকে। দিনটি ১৭ ডিসেম্বর। দুলালবাবুকে যেতে না দিলেও পাইকপাড়ার ওই মঞ্চে রাজদর্শন নাটকটি হবে বলে জানিয়েছেন আইজি (কারা) রণবীর কুমার। তাঁর কথায়, “নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী নাটক হবে। এবং সেটা দুলালবাবুকে ছাড়াই।”
সিপিএমের এই ডাকসাইটে নেতার জেলজীবনে অনিয়মের কোনও অভিযোগ নেই। জেল সূত্রের খবর, রাজদর্শন নাটক মঞ্চস্থ হবে জেনে শুরু থেকেই তার প্রযোজনার সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হয়েছেন দুলালবাবু। তা হলে কেন তাকে বাদ দিয়ে শো হবে? আইজি-র বক্তব্য, “শুধু নাটক করলেই হল না। আমাদের নিরাপত্তার দিকটিও ভাবতে হয়। ওই এলাকায় দুলালবাবু এক জন বিতর্কিত রাজনৈতিক চরিত্র। ওঁর অনুগামী এবং বিরোধী-- দু’তরফ থেকেই সমস্যা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কোনও ঝুঁকি নিচ্ছি না।” কারা দফতরের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন প্রবীণ পুলিশ কর্তারাও। এক কর্তার কথায়, “দুলালবাবুকে নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া যায় না। কোনও একটা ঘটনা ঘটে যেতেই পারে। তখন?”
এই সিদ্ধান্তে হতাশ নন নাটকের পরিচালক স্বপন ভট্টাচার্য ও আয়োজক নেয়ারাবাগান তরুণ সঙ্ঘ। স্বপনবাবু বলেন, “এটা তো হতেই পারে। নিরাপত্তার দিকটি তো প্রশাসনকে ভেবে দেখতেই হবে। না হলে তো আসল উদ্দেশ্যটাই এলোমেলো হয়ে যাবে।” স্বপনবাবু জানাচ্ছেন, মনোজ মিত্রের লেখা ‘রাজদর্শন’ নাটকে গ্রামবাসীর চরিত্রে অভিনয় করার কথা দুলালবাবুর। গ্রামবাসীদের বেশির ভাগ অভিনয়ই কোরাস-এ রয়েছে। তাই উনি না থাকলে বড় সমস্যা হবে না।
অন্য দিকে আয়োজক ক্লাবের সম্পাদক মিন্টু সরকার বলছেন, “নাটকটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য, দুলালবাবু নয়। আমরা এই প্রয়াসটাকে উৎসাহ দিতে চাই।” মিন্টুবাবুর আরও দাবি, “ভবানীপুরে আমরা যখন প্রথম নাটকটা দেখেছিলাম তখন জানতামই না ওটায় দুলালবাবু অভিনয় করছেন। যখন জেনেছি তখন আমাদের নাটকের বায়না হয়ে গিয়েছে।”
এই নেয়ারাবাগান তরুণ সঙ্ঘের মাঠই দুলালবাবুর জীবনে বধ্যভূমি হয়ে রয়েছে। দশ বছর আগে, ২০০২ সালের ৪ মার্চ এই মাঠেই দুলালবাবু এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করে বলে অভিযোগ। আর পাঁচটা মামলার মতো এই জোড়া খুনের মামলাও ধামা চাপা পড়ে যাবে বলে মনে করেছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। কিন্তু সেই সময়ে কাশীপুর থানার ওসি অনিল জানার নেতৃত্বে পুলিশ দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা দুলালবাবু-সহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয় দুলালবাবুর। সেই থেকে জেলজীবনের শুরু দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
দুলালবাবুকে নিয়ে অবশ্য এখন আর মুখ খুলতে চান না তার ‘কমরেডরা’। মুখ খুলতে সাহস পান না স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে এলাকার এক প্রবীণ বাসিন্দার কথায়, “দুলালবাবু কিন্তু খুব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। পরে পাল্টে গিয়েছিলেন।” ক্লাবের এক সদস্যের কথায়, “এই নেয়ারাবাগান ক্লাবেই দুলালবাবু অনেক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন। সেগুলি এখনও হয়।” জেল সূত্রের খবর, রাজদর্শন নাটকে ৩৩ জন অভিনয় করছেন। এর মধ্যে ৩১ জনই সাজাপ্রাপ্ত বন্দি। এদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। বাকি দু’জন জেলকর্মী। পুজোর সময়ে এই নাটক প্রথম বাইরে মঞ্চস্থ হয় রাজ্যের ক্রীড়া ও পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রের পাড়া ভবানীপুর অগ্রদূত সংঘে। তার পরে ২৪ নভেম্বর বেহালার পল্লীবাসী ক্লাবে ফের শো হয় ‘রাজদর্শন’-এর। দু’টি জায়গাতেই অভিনয় করেছেন দুলালবাবু।
রাজদর্শন-এর শোয়ে বন্দি-অভিনেতাদের উপর নিষেধাজ্ঞা অবশ্য নতুন নয়। নিরাপত্তার কারণে ইতিমধ্যেই ওই নাটকের বাইরের শো থেকে বাদ পড়েছেন মাওবাদী বন্দি সন্তোষ দেবনাথ। তাঁকে জেলের বাইরে কোনও শোয়েই অভিনয় করতে দেওয়া হয়নি। এক জেল কর্তার কথায়, “খোলা জায়গায় সন্তোষ আর কখনও নাটক করার অনুমতিই পাবে না। দুলালবাবুর ক্ষেত্রে তা নয়। নোয়ারাবাগানে তিনি ব্রাত্য। অন্যত্র কোনও বাধা নেই।” |