দেড় বছর পার হয়ে গেল। জমি-নীতি পড়ে আছে সেই তিমিরেই।
গত বছর ২০ মে শপথ নেওয়ার পরে বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি নেওয়া হবে না বলে যে ঘোষণা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুক্রবার দেশি-বিদেশি নবীন প্রজন্মের শিল্পপতিদের সংগঠন ‘ইয়ং প্রেসিডেন্টস অগার্নাইজেশন’-এর সভাতেও তার থেকে এক চুল নড়চড় হল না তাঁর। তরুণ শিল্পপতিদের প্রশ্নের জবাবে নিজেদের জমি-নীতি আর এক বার স্পষ্ট করে দিলেন তিনি: শিল্পকে এক ছটাক জমিও অধিগ্রহণ করে দেবে না সরকার। এমনকী, জমি কেনার সময় মধ্যস্থতা করারও কোনও ইঙ্গিত দিলেন না তিনি।
জমি-আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু শিল্পমহলের সামনে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেও এত দিন ধরে কসুর করেননি। শিল্পসম্মেলন, শিল্পপতিদের নিয়ে বিজয়া সম্মেলন করে তিনি বারবার তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের শিল্প গড়তে ডাক দিয়েছেন। বলেছেন, জমি কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু বিভিন্ন ভাবে ভুক্তভোগী শিল্পমহল বলছে, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে রাজ্যের এই অনমনীয় মনোভাবই শিল্পায়নের পথে সব থেকে বড় কাঁটা। কেন? তাঁরা এ দিনও বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য, যেখানে ভূমি সংস্কারের জেরে মাথাপিছু জমির পরিমাণ অন্য রাজ্যের চেয়ে অনেক কম, সেখানে বড় শিল্পের জন্য একলপ্তে বড় জমি কোনও সংস্থার পক্ষে জোগাড় করা কঠিন। কারণ, রাজ্যের নীতি মেনে চলতে হলে বিপুল সংখ্যক জমিদাতার সঙ্গে লগ্নিকারীকে কথা বলতে হবে। এ ভাবে কারখানা গড়া অসম্ভব। ইতিমধ্যেই সেই কাজে ধাক্কা খেয়েছে কিছু বড় শিল্প সংস্থা। তাঁদের দাবি, এ ক্ষেত্রে তাই সরকারি মধ্যস্থতা একান্তই জরুরি। |
‘ইয়ং প্রেসিডেন্টস অগার্নাইজেশন’-এর সভায় মুখ্যমন্ত্রী।—নিজস্ব চিত্র |
শিল্পমহলের একাংশের বক্তব্য, কেন্দ্র যে খসড়া জমি-নীতি তৈরি করেছে, সেখানেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সহমতের কথা বলা হয়েছে। সিঙ্গুরে টাটাদের কারখানার ক্ষেত্রেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জমিদাতারই সম্মতি মিলেছিল। কর্নাটক-সহ কিছু রাজ্যেও জমি কেনার ক্ষেত্রে কিছুটা সাহায্য করে রাজ্য। কোথাওই ১০০ শতাংশ জমি কিনতে হয় না লগ্নিকারীকে। সরকারি মধ্যস্থতা মেলেই।
এ দিন সভায় কী হয়েছিল? সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, সভায় এক প্রশ্নকর্তা মমতার কাছে জানতে চান, রাজ্যের জমি-নীতি কী? জবাবে মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যের জমি-নীতি স্পষ্ট। লগ্নিকারীদের সরাসরিই জমি কিনতে হবে। তাঁরা শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরোধী। বিশেষ করে কৃষিজমি নিয়ে শিল্প করারও বিরোধী তাঁরা। তাঁর যুক্তি, কৃষি জমিতে জোর করে শিল্প করলে গোলমাল হয়। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য যেখানে বেশির ভাগটাই কৃষি জমি, সেখানে তা হলে কী করে শিল্প হবে, তার কোনও দিশা দেননি তিনি। তবে কেউ স্বেচ্ছায় জমি দিতে চাইলে তিনি দিতে পারেন বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। কেউ কেউ বলছেন, “রাজ্যের নীতি স্পষ্ট। আর এটাও স্পষ্ট যে, সেই নীতি মেনেই কারখানা তৈরি হচ্ছে না এখানে!”
শুধু বড় জমি একলপ্তে পাওয়া কঠিন বলেই নয়, শিল্পমহল শঙ্কিত দালালরাজ নিয়েও। জমি কিনে কারখানা গড়তে ইচ্ছুক লগ্নিকারীদের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, জমি কেনার প্রক্রিয়া শুরুর অনেক আগে থেকেই সক্রিয় হয় দালালরা। রোজই জমির দাম বাড়ে। অস্থিরতার ফাঁসে পিছিয়ে যান লগ্নিকারীরা।
একমাত্র জমি-নীতিতেই সমস্যার শেষ নয়। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহার করা বা কোনও প্রকল্পকে এসইজেড তকমা দেওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর যে প্রবল আপত্তি আছে, তা-ও শিল্পের পথে বাধা বলে মনে করছেন শিল্পপতিরা। আর বলছেন, এ সবের জাঁতাকলেই রাজ্যের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।
সাধারণ ভাবে রাজ্যের সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী যা বলে থাকেন, এ দিন সভায় কার্যত সেই একই সুর ছিল তাঁর গলায়। যেমন, বাম আমলের ঋণের বিপুল বোঝা, তা সত্ত্বেও রাজ্যের আর্থিক উন্নয়ন, কেন্দ্রের বঞ্চনা, ছবি এঁকে দলের জন্য অর্থ সঙ্কুলান, বিরোধীদল, সংবাদমাধ্যমের একাংশের অপপ্রচার ইত্যাদি। আর মজার বিষয়, এত বার শিল্পের আহ্বান সত্ত্বেও তাঁর সরকারের অধিগ্রহণ নীতির যে সমালোচনা করে থাকেন শিল্পপতিরা, এ দিন তাঁদের মুখে ছিল সেই পুরনো সংশয়ই।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য সরকারি জমি নিলাম করার নতুন নীতির কথাও জানিয়েছেন। যা বৃহস্পতিবারই ঘোষণা করা হয়েছে। শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েন্কাও সেই নীতির প্রশংসা করে বলেন, রাতারাতি লগ্নি আসে না। রাজ্যে একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। |