ঠোঙায় দু’টাকার মুড়ি। কিন্তু সে ঠোঙা কিনলে দিতে হবে সাত-আট টাকা। রহস্য লুকিয়ে মুড়ির নীচে। ১৮০ মিলি চোলাইয়ের পাউচ (ক্রেতা-বিক্রেতার ভাষায়, ‘পেপসি’)। দাম পাঁচ টাকা। মগরাহাটে বিষমদ-কাণ্ডের বর্ষপূর্তির মুখে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় রমরমা ‘পেপসি-ঠোঙা’র।
২০১১-র ১৪ ডিসেম্বর উস্তি থানার সংগ্রামপুরের কয়েকটি ঠেক থেকে বিষ-মদ পানে ১৭২ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঠেকের মালিক খোঁড়া বাদশা-সহ ২১ জনকে ধরেছিল পুলিশ। বিষ-মদ কাণ্ডের মামলা বিচারাধীন। ওই মৃত্যু মিছিলের পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় চোলাই ভাটি ভাঙার অভিযানে নেমেছিল পুলিশ ও আবগারি দফতর। জয়নগর, মগরহাট, উস্তিতে চোলাইয়ের বহু ভাটি ভাঙা হয় সে সময়। ওই ঘটনার পরে জেলার প্রতিটি থানায় চোলাই রুখতে করা অভিযানের মাসিক তথ্য রাখা বাধ্যতামূলক করেছিল রাজ্য। তল্লাশি অভিযানও বেড়েছে। তার পরেও কী করে জেলায় এই ‘পেপসি-ঠোঙা’র রমরমা? জেলার এসপি প্রবীণ ত্রিপাঠির দাবি, “গত এক বছরে জেলায় প্রায় ২ লক্ষ লিটার চোলাই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ৫৭ জন চোলাই তৈরির অভিযোগে ধরা পড়েছে।”
কিন্তু চোলাই-সমস্যা যে রয়ে গিয়েছে, তা মানছে জেলা পুলিশ ও আবগারি দফতরের একাংশ। |
আবগারি দফতরের দাবি, তাদের পরিকাঠামোগত সমস্যার প্রভাব পড়ছে নজরদারিতে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৩৪টি থানা এলাকায় আবগারি দফতরের আটটি সার্কেল রয়েছে। আবগারি দফতরের এক কর্তার কথায়, “আগে জানতাম, জয়নগরের গোচরণে, পূর্ব-পাঁচগাছিয়ায় চোলাই-ভাটি চলে। ভাটি ভাঙা হল। কিন্তু এখন চোলাই তৈরি হচ্ছে লুকিয়ে। কখনও গৃহস্থের রান্নাঘরেও। সে সব প্রত্যন্ত এলাকায় নজরদারি মুশকিল।”
আবগারি দফতরের ‘নিধিরাম সর্দার’ দশা কাটার একটা ইঙ্গিত অবশ্য মিলেছে। সরকারি সূত্রের খবর, দফতরের শূন্যপদ পূরণের জন্য ৬০০ জন কর্মী নিয়োগের প্রস্তাব হয়েছে। মূলত সাব-ইনস্পেক্টর এবং কনস্টেবল পদে নিয়োগ হওয়ার কথা। প্রস্তাবটি আপাতত রাজ্য মন্ত্রিসভার অনুমোদনের অপেক্ষায়। প্রস্তাব অনুযায়ী, গোটা রাজ্যে নতুন তিনটি আবগারি জেলা তৈরি হবে। বর্তমানে আছে ২১টি।
লোক নিলেই কি সমস্যা মিটবে? কারণ সর্ষের মধ্যেই যে ভূত আছে!
বস্তুত, ভাটি থেকে ঠেক পর্যন্ত চোলাই গতিবিধির মানচিত্র অজানা নয় আবগারি দফতর বা পুলিশের। তাদের বিলক্ষণ জানা আছে, ভাঙড়ের হরিশপুরের ভাটিতে তৈরি চোলাই যায় সোনারপুর, বারুইপুরে। বিষ্ণুপুরের চোলাই পৈলান হয়ে ঢোকে শিরাকোল, ডায়মন্ড হারবার, বারুইপুরে। আবার উস্তির মশাটের ‘পেপসি’ পৌঁছয় মগরাহাট, সংগ্রামপুরে। আর লক্ষ্মীকান্তপুরের চোলাইয়ের গন্তব্য নামখানা, কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার।
তা হলে নজরদারি চালালেই তো হয়? “হয় না”, বলছেন এক আবগারি কর্তা। তাঁর ব্যাখ্যা, এক শ্রেণির সরকারি ও পুলিশকর্মীর যোগসাজশে এবং স্থানীয় কিছু নেতার মদতে চলছে এই কারবার। কবে, কোথায় অভিযান হবে, আগে থেকেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। যে চোলাই বাজেয়াপ্ত হচ্ছে, তা-ও পরিমাণে নগণ্য। এক দিন ভাটি ভাঙা হলে, পর দিন ভাটি গজিয়ে উঠছে সেই এলাকার বাঁশঝাড়ে বা ফাঁকা মাঠে।
প্রশাসনেরই একাংশ বলছে, গরিব লোকের চাহিদা রয়েছে মদ খাওয়ার। দেশি মদের দোকানও নাগালের মধ্যে নেই। যতদিন না দেশি মদ সুলভে মিলছে, ততদিন চোলাই ঠেকের বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো সম্ভব নয় বলে ওই অংশের অভিমত। |
দঃ ২৪ পরগনা আবগারি দফতরের পরিকাঠামো |
• মোট কর্মী-৭৪।
• মোট সার্কেল-আটটি।
• গাড়ি-চারটি।
• প্রতি সার্কেল-এ কর্মী ন’জন।
• সার্কেল-এর এলাকা অন্তত ৫০০ বর্গকিমি। |
|