যাহা বলা হয়, তাহার তুলনায় যাহা বলা হয় না, তাহার গুরুত্ব কিছু কম নহে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর দুব্বুরি সুব্বারাও যেমন কলিকাতা সফরে আসিয়া বলিলেন, বিভিন্ন রাজ্যে চিটফান্ডের রমরমা চলিতেছে। সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনিবার দায়িত্ব মূলত রাজ্য সরকারের। কেন কলিকাতায় আসিয়াই সুব্বারাও চিটফান্ডের প্রসঙ্গ তুলিলেন, তাহা তিনি ভাঙিয়া বলেন নাই। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ থাক। বঙ্গজনের ভয়াবহ স্মৃতিতে সঞ্চয়িতা প্রকল্পের ক্ষত এখনও অতীতে মিলাইয়া যায় নাই। তবে, চিটফান্ডমাত্রেই যে লোক ঠকাইবার ব্যবসা, তাহা নহে। দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে, বিশেষত কেরলে, আইন মানিয়া চিটফান্ড চলে। সমস্যা যে প্রকল্পগুলিকে ঘিরিয়া, সেইগুলি চারিত্রিক ভাবে পঞ্জি স্কিম বা পিরামিড স্কিম জাতীয় আর্থিক বেনিয়মের জাতের। এই প্রকল্পগুলির সূচনালগ্ন হইতেই একটিমাত্র উদ্দেশ্য থাকে বিনিয়োগকারীদের ঠকাইয়া তাঁহাদের লগ্নির অর্থ আত্মসাৎ করা। অসৎ উদ্দেশ্যেই যে প্রকল্পের জন্ম, কিছু লক্ষণ দেখিয়া সেগুলিকে চিনিয়া লওয়া যায়। সেগুলির মধ্যে প্রথমটি হইল অতি উচ্চ হারে লাভের প্রতিশ্রুতি। যখন ব্যাঙ্কে সুদের হার সাড়ে সাত শতাংশ, শেয়ার বাজারের বিনিয়োগও বৎসরে বড় জোর ১২ শতাংশ লাভ দিতে পারে, তখন কোনও একটি প্রকল্প যদি বাৎসরিক ২৫ শতাংশ লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে সেই প্রকল্পটিকে লইয়া সন্দিহান হইবার কারণ বিলক্ষণ আছে। কোন বাজারে লগ্নি করিয়া এত উপার্জন হইবে যে প্রকল্পের চালক সংস্থা নিজেদের লাভ রাখিয়াও এত টাকা সুদ দিতে পারিবেন?
সমস্যা হইল, যে প্রশ্নে সন্দেহ হওয়ার কথা, মানুষের সেই প্রশ্নেই লোভ হয়। বিশেষত অতি স্বল্প পুঁজির, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের শেয়ার বাজারও অধিকাংশ সময় যাঁহাদের আওতার বাহিরে থাকে। তাঁহারা বিপদের কথা জানেন না, তাহা নহে তবুও এই জাতীয় প্রকল্পের ফাঁদে পা দেন। কেন, মনস্তত্ত্বে তাহার বিস্তারিত উত্তর আছে। প্রকল্পটির প্রাথমিক পর্যায়ে সত্যই উঁচু হারে লাভ পাওয়া যায়। তাহা কাকতালীয় নহে চালক-গোষ্ঠী আরও অনেক গ্রাহককে লোভ দেখাইতে প্রথম দফায় চড়া সুদ দেয়। বিনিয়োগকারীর সংখ্যা যত বাড়ে, সংস্থার তহবিলও ততই ফুলিয়া-ফাঁপিয়া উঠে। এই টাকা কোনও বাজারে বিনিয়োগ করা হয় না টাকার এক ভাগ যায় বিনিয়োগকারীদের সুদ দিতে, বাকিটা চালক-গোষ্ঠীর পকেটে। এই ভাবে ব্যবসা কত দিন চলিবে, তাহার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নাই। হইতে পারে, কোনও এক দিন চালক-গোষ্ঠী বেমালুম পাততাড়ি গুটাইবে। অথবা, কোনও কারণে বিনিয়োগকারীদের মনে প্রকল্পটি লইয়া সংশয় তৈরি হইলে যদি টাকা তুলিয়া লওয়ার হিড়িক পড়ে, তখনও সংস্থাটি লাটে উঠিবে। দেশের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হইলেও একই ফল। মোট কথা, যে কারণেই সংস্থাটি বন্ধ হউক, বহু মানুষের টাকা মার যাইবে। বিশেষত যাঁহারা শেষের দিকে বিনিয়োগ করিয়াছেন, তাঁহাদের। এই দুর্নীতি ঠেকাইবার দায় অবশ্যই সরকারের। সুব্বারাওয়ের পরামর্শ মানিয়া সরকার সেই কাজে উদ্যোগী হউক। |