ভারতীয়রা কি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের যোগ্য, অন্তত তাহার ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের যে পরিষদীয় বন্দোবস্তটি দেশে বর্তমানে কায়েম রহিয়াছে, তাহার? দেশের নির্বাচিত আইনসভাগুলির ভিতর নিয়ত যে সব কাণ্ড ঘটিতেছে, তাহা দেখিলে এই সংশয় জাগা স্বাভাবিক। কী রাজ্যে, কী কেন্দ্রে, কী বিধানসভায়, কী লোকসভা-রাজ্যসভায় সর্ব স্তরেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আচরণ দেখাইয়া দিতেছে যে, আইনসভা তথা পরিষদীয় মঞ্চকে জনস্বার্থে ব্যবহার করার যোগ্যতা ভারতবাসী এখনও অর্জন করে নাই, রাজনীতিকে এখনও রাস্তাঘাটের, মেছোহাটার, চণ্ডীমণ্ডপের আখড়াই রূপে ব্যবহার করিতেই তাহারা অধিকতর দক্ষ হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ তো আরও এক কাঠি বাড়া। এ রাজ্যের বিধানসভায় তো মল্লভূমির পালোয়ানি মঞ্চ খোলাই ছিল। শাসক দল হউক কিংবা বিরোধী, বিধায়করা বিরোধের নিষ্পত্তি মৌখিক তর্ক নয়, পেশিবল নির্ভর করিয়াই করিতে সকলে সদা-উৎসুক। সেই সূত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সভাকক্ষে এমন সব আচরণ করিয়াছেন, যাহাকে ঠিক ‘আদর্শ আচরণ’ বলা যায় না। আইনসভার ভিতরে এক দলের বিধায়কদের হাতেই যখন অন্য দলের বিধায়ক শারীরিক নিগ্রহে আহত হন এবং মহিলা জনপ্রতিনিধিরাও রেহাই পান না, তখন সন্দেহ হয়, এ দেশের, তথা এ রাজ্যের অধিবাসীরা কি পরিষদীয় গণতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি লইয়াছে? গণতন্ত্রের অধিকার অর্জন করিয়াছে?
গণতন্ত্রের পরম পীঠস্থান সংসদের দিকে তাকাইলে দেখা যায়, নিত্য সেখানে সভা ভন্ডুল করার আয়োজন। বিরোধী সাংসদদের একমাত্র লক্ষ্য, অধিবেশন শুরু হইতে-না-হইতে তাহা মুলতুবি করিয়া দেওয়া। প্রতিবাদে ওয়াক-আউট করা নয়, চিৎকার-চেঁচামেচি করিয়া, সভার ‘ওয়েল’-এ নামিয়া, সভাধ্যক্ষের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করিয়া এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যাহাতে সুষ্ঠু ভাবে সভা চালানো অসম্ভব হইয়া উঠে। সংসদের একের পর এক অধিবেশন এ ভাবেই বিরোধী সাংসদরা বানচাল করিতেছেন। বৃহস্পতিবার যেমন সংসদে সন্ত্রাসবাদী হামলার ১১তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিজেপি সাংসদরা প্রাণপণে মুলতুবি প্রস্তাব আনিতে চাপ দিতেছিলেন। মীরা কুমারের মতো ঠান্ডা মাথার স্পিকারও বাধ্য হইয়া কিছুটা উত্তেজিত স্বরেই জানাইয়া দেন, সভা মুলতুবি করা হামলায় হতাহতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের সঠিক পন্থা নয়। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিকে বহুজনসমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী ‘কর্তব্যচ্যুতি’র জন্য তিরস্কার করিতেছেন! বিজেপি সাংসদরা নিয়মিত প্রশ্নোত্তর পর্ব বানচাল করিয়া তাঁহাদের আনীত প্রসঙ্গে আলোচনা করিতে সভাকে এমন ভাবে বাধ্য করিতেছেন যে, আনসারি প্রশ্নোত্তর পর্বই তুলিয়া দিবার কিংবা বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত লইতেছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পক্ষে এ সব কিছুতেই শুভ লক্ষণ হইতে পারে না।
গণতন্ত্র মানে কেবল নিয়ম করিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জনপ্রতিনিধিসভার কাজকর্ম সুচারু ভাবে সম্পন্ন করাও গণতন্ত্রেরই দায়। মনে রাখা উচিত, যাহারা সংসদ-ভবন আক্রমণ করে, তাহারাই কেবল গণতন্ত্রের মূলে আঘাত করে না। যাহারা ঠান্ডা মাথায় নির্বাচিত আইনসভাগুলির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাত করে, সভার অধিবেশন ভন্ডুল করিয়া সরকারের বিল পাশের প্রয়াসে বাধা সৃষ্টি করে, জনসাধারণের করের অর্থে চলা গোটা সংসদীয় প্রক্রিয়াকে নিষ্ফল করিয়া তোলে, তাহারাও গণতন্ত্রের কম ক্ষতি করে না। ভারতীয় রাজনীতিতে গণতন্ত্রের কোনও ধারাবাহিক ঐতিহ্য কখনওই ছিল না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা উপনিবেশ ছাড়িয়া যাওয়ার সময় এই বন্দোবস্তটি ভারতকে ধার দিয়া গিয়াছিলেন। আশা ছিল, ক্রমশ ভারতীয় সমাজ প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনের প্রক্রিয়াটিকে রপ্ত করিয়া লইবে। বহিরঙ্গ রূপের নিরিখে ভারতবাসী পশ্চিমি গণতন্ত্রের উপচারগুলি আয়ত্ত করিয়াছে বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের আত্মা এখনও ভারতবাসীর অধরা। তাই তাঁহাদের নির্বাচিত আইনসভাগুলি আজও চণ্ডীমণ্ডপের সংকীর্ণ বিবাদমুখরতার পরিসর অতিক্রম করিতে অপারগ। |