প্রবন্ধ ১...
গণতন্ত্রই ইসলামপন্থীদের জিতিয়েছে
রব বসন্তের উচ্ছ্বাস রুদ্ধ করে মিশরে জাঁকিয়ে বসছে স্বৈরাচার। নতুন করে উঠে পড়ছে পুরনো প্রশ্ন গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামকে কি আদৌ মেলানো যায়? হোসনি মুবারকের সামরিক একনায়কতন্ত্র ছুড়ে ফেলার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা এবং গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্সি নিজের হাতে যাবতীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে মিশরের গণতান্ত্রিক বিপ্লবকেই ছিনতাই করেছেন, এই অভিযোগে তাঁর বিরোধীরা আবার আরব বসন্তের নন্দনকানন সেই তাহরির স্কোয়ারেই সমবেত। প্রেসিডেন্টের সমর্থক ব্রাদারহুড স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষও চলছে, ইতিমধ্যেই অন্তত ৭জন নিহত, আহত সাত শতাধিক।
দুটি কারণে নতুন করে গোলমালের শুরু।
, প্রেসিডেন্ট মুর্সির জারি করা এক ডিক্রি, যার বলে তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার আইনি বৈধতা দেশের বিচারবিভাগও পরীক্ষা করে দেখার অধিকারী নয়।
, শনিবার অনুষ্ঠেয় খসড়া সংবিধানের উপর গণভোট। বিরোধীদের আন্দোলন, গণ-জমায়েত এবং ঘরে-বাইরে প্রবল চাপ ও সমালোচনার মুখে মুর্সি নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা সংক্রান্ত ডিক্রিটি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু সংবিধানের উপর গণভোটের নির্ঘণ্ট অপরিবর্তিত। তাই প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের সামনে বিরোধী সমাবেশ অব্যাহত।
রাজকীয় সেই প্রাসাদ অবশ্য ঘিরে রেখেছে নিরাপত্তারক্ষীরা। সাঁজোয়া গাড়ির নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন একজন প্রেসিডেন্টকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হচ্ছে, এমন পরিহাসের নজির ইতিহাসে অসংখ্য। ‘দ্য কিংডম অব দিস ওয়ার্ল্ড’ উপন্যাসে ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে হাইতির দাস-বিপ্লবের এমনই এক মর্মান্তিক পরিণতির আখ্যান লিপিবদ্ধ করেছিলেন কিউবার ঔপন্যাসিক আলেহো কার্পেন্তিয়ের, যে-আখ্যানবৃত্তে দাস-বিদ্রোহের নায়ক আঁরি ক্রিস্তফ রাষ্ট্রনায়ক হয়ে প্রথমেই সহকর্মী দাসদের উপর ঔপনিবেশিকের চাবুক, নিগ্রহ ও লাঞ্ছনা নামিয়ে আনেন। মিশরের সেনাপ্রধানদের অপসারিত করে ইতিপূর্বেই প্রেসিডেন্ট মুর্সি মুসলিম ব্রাদারহুডের অনুরাগী জেনারেলদের বসিয়ে দিয়েছেন। উপরন্তু সদ্য-সদ্য ঘোষিত এক ডিক্রিতে সামরিক আইন জারির অধিকার অনুমোদন করিয়ে ‘আইনের শাসন’ রক্ষায় অসামরিক প্রতিবাদীদের গ্রেফতার করার যথেচ্ছ এক্তিয়ারও বাহিনীর হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। হোসনি মুবারকের সামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে সাংবিধানিক গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় ক্রমেই অন্তর্ঘাত ঘটছে।
মুর্সি যে খসড়া সংবিধানকে গণভোটের সিলমোহরে বৈধ করে নিতে আগ্রহী, তার মোদ্দা বিষয় কী? বিরোধীদের বক্তব্য খসড়ায় মহিলাদের সমানাধিকার এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের রক্ষাকবচ রাখা হয়নি, প্রেসিডেন্টের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণেরও কোনও ব্যবস্থা নেই। সংবিধান রচনার কথা ছিল নির্বাচিত পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের। কিন্তু মুবারক-অনুরক্ত বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত শীর্ষ সাংবিধানিক আদালত নিম্নকক্ষ বাতিল করে দেওয়ায় উচ্চতর কক্ষই এ কাজে নিয়োজিত হয়। প্রেসিডেন্ট মুর্সির আশঙ্কা, উচ্চতর কক্ষটিও আদালত রদ করে দিতে পারে, তাই তড়িঘড়ি খসড়া সংবিধানকে গণভোটে পাশ করানোর তাগিদ। বিরোধীদের যে-প্রতিনিধিরা খসড়া সংবিধানে আপত্তি জানাচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু খসড়া রচনার সময় উচ্চতর কক্ষে হাজির হননি। বরং দিনের পর দিন সভা ‘বয়কট’ করে ব্রাদারহুড সমর্থকদের একতরফা খসড়া রচনার পথই সুগম করেছেন। সংবিধান নিয়ে যে-সব আপত্তি তাঁরা তাহ্রির স্কোয়ারের জমায়েত গরম করতে কিংবা পশ্চিমী গণমাধ্যমের খোরাক জোগাতে উচ্চারণ করছেন, সংবিধানসভায় খসড়া রচনা কালে তা করা উচিত ছিল।
প্রতিবাদের স্বাধীনতা। প্রেসিডেন্ট মুর্সির বিরুদ্ধে স্লোগান। কায়রো, ডিসেম্বর ’১২। ছবি: এ এফ পি
মিশরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কায়েমের গোটা পর্বটি খুবই জটিল। পরিস্থিতি সম্পর্কে মুক্ত দুনিয়া ও তার সেকুলার গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের বিভ্রান্তিও কম নয়। বাস্তব এই যে, জাতীয় ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিশরের শাসনক্ষমতায় ইসলামপন্থীরাই উঠে এসেছেন। এটা মুক্ত দুনিয়ার অপছন্দের বিষয় হতে পারে, কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডই যে মিশরের একমাত্র সংগঠিত সামাজিক শক্তি, যা ধারাবাহিক ভাবে নাসের, আনোয়ার সাদাত ও হোসনি মুবারক জমানার সামরিক স্বৈরাচারের মহড়া নিয়ে এসেছে, এটা মেনে নেওয়া উচিত। ব্রাদারহুডের নেতা হিসাবেই মহম্মদ মুর্সি মুবারকের জেলে বন্দি থেকেছেন। সংশয় হয়, তাহ্রির স্কোয়ারের জমায়েত থেকে যে সেকুলার গণতন্ত্রীরা মুর্সিকে আবার জেলে পাঠানোর স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদের আড়ালে মুবারকের লোকেরা লুকিয়ে নেই তো?
হোসনি মুবারকের পতন হলেও মিশরে নাসের-সাদাত-মুবারক স্বৈরাচারের অবসান সহজ নয়। সেনাবাহিনী, বিচারবিভাগ, প্রশাসনে মুবারক-অনুগৃহীতদের প্রভাব রাতারাতি লুপ্ত হবারও নয়। মহম্মদ মুর্সি বা অন্য যে কেউই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতেন, তাঁকে মুবারক জমানার রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-সামরিক অবশেষগুলির বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যেতে হত। মিশরের যে সেকুলার গণতন্ত্রীরা আজ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁরাও মুবারক-স্বৈরতন্ত্রের উচ্ছেদের লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন, এটা সত্য। কিন্তু কোনও পর্যায়েই তাঁরা সেই সংগ্রামের মূল শক্তি বা নির্ধারক উপাদান ছিলেন না। এলবারাদেই-এর মতো আন্তর্জাতিক প্রচারের আলোয় উদ্ভাসিত যে-সব মিশরীয় রাজনীতিক আজ মুর্সি-বিরোধী ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্টের নেতা হয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন, মিশরের জনসমাজে তাঁদের যথেষ্ট গণভিত্তি নেই। অবশিষ্ট বিশ্ব, বিশেষত মুক্ত দুনিয়ার কাছে তাঁরা মিশরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ‘প্রকাশ্য মুখ’ তথা ‘আরব বসন্তের অগ্রদূত’ প্রতিভাত হতেই পারেন। মিশরবাসীর কাছে কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডই সুখদুঃখের সাথী। এই ইসলামপন্থীরা যে নির্বাচনে গরিষ্ঠতা পাবেন, এটা ইতিহাসনির্দিষ্ট ছিল। সংবিধানসভা বা গণপরিষদেও তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন। গণতন্ত্রকে শিরোধার্য করতে হলে ব্রাদারহুডের এই প্রাধান্য নব্য মিশরের রাজনীতিতে বরণ করে নেওয়াই সমীচীন।
প্রশ্ন উঠছে, তবে কি মুবারক-উত্তর মিশরের নারীদের বোরখার আড়ালে নির্বাসিত হতে হবে? কপ্টিক খ্রিস্টানদের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতিত হতে হবে সুন্নি মুসলমানদের হাতে? কেননা উদারনৈতিক সেকুলার গণতন্ত্রীদের মতে, খসড়া সংবিধান গৃহীত হলে নাকি সেটাই ঘটবে। এখানে দু’একটা কথা বলা দরকার। প্রথমত, মিশরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মহিলা মুবা চাপের মুখে যদি প্রেসিডেন্ট মুর্সি সংবিধান খসড়ার উপর গণভোট রদ বা স্থগিত করেন, অন্য কথা। না করলে খসড়া সংবিধান অনুমোদিত হবেই, ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট বয়কট করলেও হেরফের হবে না। সে ক্ষেত্রে এই ফ্রন্টের প্রাসঙ্গিকতা তলানিতে এসে ঠেকতে পারে। লিবিয়ায় গদ্দাফি-বিরোধী ফ্রন্টের দশা কী হয়েছে, দেখাই যাচ্ছে। সিরিয়াতেই বা আসাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী মোর্চার অবস্থা কেমন? আসলে এলবারাদেই-এর মতো পাশ্চাত্যশিক্ষিত রাজনীতিকরা গণতন্ত্র বলতে যে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের ধারণা আত্মস্থ করেছেন, ইসলামে তার স্থান নেই। কোনও মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র শরিয়তকে শিরোধার্য করে বা না করে যে-গণতন্ত্রকে বরণ করতে পারে, সেখানে ব্রাদারহুডের মতো নমনীয়, মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ইসলামই ক্ষমতাসীন হবে, ব্রিটিশ, ফরাসি, মার্কিন বা স্ক্যান্ডিনেভীয় ধাঁচের গণতান্ত্রিক দলগুলি নয়। অন্যথায় সৌদি আরব, ওমান, মরক্কো কিংবা আমিরশাহির মতো রাজতন্ত্র। আরব বসন্তের পর ইসলামের ভুবনে মুক্ত দুনিয়া অনুমোদিত সামরিক স্বৈরাচার ক্রমেই অবান্তর হতে থাকবে। নমনীয়, মধ্যপন্থী, আপসে-প্রস্তুত রাজনৈতিক ইসলাম যদি গণতন্ত্রের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, সেটাই শ্রেয় হবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.