এই বার কি মানবীবিদ্যার মতো মানবী বিশ্ববিদ্যালয়? পশ্চিমবঙ্গ কি তবে এক নূতন গোত্রের বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে যাত্রা করিতেছে? ডায়মন্ডহারবার রোডের উপর একটি মানবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হইল রাজ্য বিধানসভায়, তাহার জন্য জমি বরাদ্দ হইল, উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর মুখে বিজয়বার্তা ঘোষিত হইল। কেবল কলিকাতাতেই নহে, পশ্চিমবঙ্গে, বস্তুত, সমগ্র পূর্ব ভারতেই ইহা প্রথম এমন ধারার প্রতিষ্ঠান। রাজ্য সরকার যে নারীসমাজের আলোকায়নের দিকে বিশেষ নজর রাখিতেছে, শিক্ষা পরিকাঠামোর বিস্তারে মন দিয়াছে, বহু অর্থে এই পরিকাঠামোকে বিকেন্দ্রিত করিতে উৎসুক হইয়াছে কলিকাতা হইতে কলিকাতার প্রান্তের দিকে, পুরুষ-সমাজ হইতে তুলনায় স্বল্পসুযোগপ্রাপ্ত মফস্সলি নারীসমাজের দিকে অগ্রসর হইতেছে, ইহা ভারী আহ্লাদের কথা। শিক্ষা, তথা উচ্চশিক্ষার শত সুযোগ বিকশিত হউক। কিন্তু, তবু, প্রশ্ন থাকিয়া যায়। একবিংশ শতকের পশ্চিমবঙ্গেও নারীসমাজের জন্য পৃথক সারস্বত প্রতিষ্ঠান তৈরি সত্যিই জরুরি কি না, সেই প্রশ্ন।
ধরিয়া লওয়া যায়, প্রশাসনের মাথায় রহিয়াছে একটি হিসাব যে, অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা উচ্চশিক্ষাগ্রহণে অপারগ হন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সহশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হইবার কারণে। অর্থাৎ মেয়েদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় হইলে আরও অনেক বেশি মেয়ে পড়ায় আগ্রহী হইবেন। ইহার উত্তরে যুক্তি এই, সমাজের যে অতি-রক্ষণশীল অংশ এই ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত, সুস্থ শিক্ষালাভের পরিবেশ নিশ্চিত করাই তাঁহাদের রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলার একমাত্র পথ। তাঁহাদের পশ্চাৎপর চিন্তা দ্বারা প্রশাসনও যদি প্রভাবিত হইয়া পশ্চাদ্মুুখী হইয়া পড়ে, তাহা দুর্ভাগ্যজনক। বরং প্রশাসন ভাবুক, রক্ষণশীল মানসিকতা ছাড়াও আর কোন কোন কারণে মেয়েরা বাড়ি হইতে কলেজে পঠনপাঠনের জন্য আসিতে পারিতেছে না। যেমন, পরিবহণের অপ্রতুলতা। নিরাপত্তার অভাব। অল্পবয়সে বিবাহের রীতি। কিংবা দ্রুত রোজগারের উপায় জোগাড় করিয়া পারিবারিক দায় পালন। এ সব সমস্যার সমাধানের দিকে প্রশাসন মন দিলে অধিকতর সুফল পাওয়া যাইবে মনে হয়।
পশ্চিমবঙ্গের নির্দিষ্ট উদ্যোগ ছাড়াইয়া সামগ্রিক ভাবে মানবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি বিচার করিতে বসিলে অন্য এক ‘যুক্তি’ও হয়তো পেশ করা হইবে। তাহা এই যে, মানবীবিদ্যার বিভিন্ন দিক লইয়া পঠনপাঠন ও গবেষণার জন্য মেয়েদের নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকা ভাল। ভারতে এমন বিশ্ববিদ্যালয় আছে এবং তাহার খ্যাতিও কম নয়। কিন্তু মানবীবিদ্যাই বা কেন কেবল মানবীদের চর্চার বিষয় হইয়া থাকিবে, সেই বৃহত্তর ও গভীরতর প্রশ্নটি তোলা জরুরি নয় কি? ঐতিহাসিক কারণে এই বিদ্যার চর্চায় মেয়েদের ভূমিকা প্রধান। কিন্তু ইতিহাসের দাসত্বও দাসত্ব বই কিছু নয়। একটি বিদ্যার চর্চা এক ভাবে চলিয়া আসিয়াছে বলিয়া সেই ভাবেই চলিবে, এমন চিন্তার মধ্যে একটি জড়তা আছে। তাহা মানবীবিদ্যার পক্ষেও ভাল নয়, মানবীদের পক্ষেও ভাল নয়, এমনকী মানবদের পক্ষেও ক্ষতিকর। অন্তত শিক্ষার ভুবনে মানবীদের জন্য অর্ধেক নয়, সম্পূর্ণ আকাশ বরাদ্দ হোক। মানবদের জন্যও। |