আমরি হাসপাতালের অ্যানেক্স ভবনের সামনে আসতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন আমরির অগ্নিকাণ্ডে স্বজন হারানো শিপ্রা সরকার। হাতে ধরা মোমবাতি। পিছনে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা মৌন মিছিল তখন থেমে গিয়েছে। অনেকেই বাক্রুদ্ধ। এই মৌন মিছিলের সকলেই ওই অগ্নিকাণ্ডে তাঁদের স্বজনকে হারিয়েছেন। কেউ হারিয়েছেন নিজের মা, কেউ ভাই, কেউ হারিয়েছেন স্বামীকে, কেউ বা তাঁর ছোট্ট মেয়েকে।
শিপ্রাদেবী আমরির ঘটনায় হারিয়েছিলেন তাঁর স্বামী কাশীনাথ সরকারকে। কাশীনাথবাবু হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন আমরিতে। যে দিন দুর্ঘটনা ঘটে, সে দিনই তাঁর হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার কথা ছিল। রবিবার আমরির সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে শিপ্রাদেবী বলেন, “গত এক বছর ধরে শুধু ভেবেছি, কেন ওঁদের উদ্ধার করতে এত দেরি হল? একটু আগে উদ্ধার হলে ওঁকে এ ভাবে বেঘোরে প্রাণ দিতে হত না। ও তো সুস্থ হয়েই গিয়েছিল।” শিপ্রাদেবীর পিছনেই মৌন মিছিলে হাঁটছিলেন ধনঞ্জয় পাল। ধনঞ্জয়বাবু আমরি দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন তাঁর ক্লাস নাইনের মেয়ে প্রাকৃতাকে। গাড়ি থেকে পড়ে মাথায় চোট পেয়ে প্রাকৃতা ভর্তি ছিল ওই অভিশপ্ত হাসপাতালে। সেই ঘটনার ঠিক এক বছর পরে ওই প্রাণঘাতী হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নির্বাক। |
স্বগতোক্তির মতো বলছিলেন, “আমার ফুলের মতো মেয়েটা এক বছর আগে চলে গিয়েছে, এখনও বিশ্বাস হয় না। বেঁচে থাকলে এ বার ও মাধ্যমিক দিত। পাশের বাড়িতে মাধ্যমিকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে আমার মেয়েরই এক বন্ধু। ওকে পড়াশোনা করতে দেখলে আমার মেয়ের কথা বেশি করে মনে পড়ে।” এরই মধ্যে মৌন মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে আমরি হাসপাতাল চত্বরে এসে পৌঁছতেই শোকে আচ্ছন্ন হয়ে জ্ঞান হারালেন রাবেকা সুলতানা। তিনি এক বছর আগে হারিয়েছিলেন তাঁর স্বামী শেখ রহমাতুল্লাকে। ওই মৌন মিছিলে হাঁটছিলেন এক জন ডাক্তারও। তিনি জানালেন, রক্তচাপ কমে গিয়েছে ওই মহিলার। তাঁকে তখন সুস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁর আত্মীয়েরা।
রবিবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ এ রকমই এক শোকগ্রস্ত মৌন মিছিল দেখল কলকাতা। এ এমনই শোক মিছিল যে, সান্ত্বনা দেওয়ার কোনও লোক নেই। এক বছর পরে আমরি হাসপাতাল যেন ওই শোকগ্রস্ত মানুষগুলোকে গিলে খেতে আসছিল। শুধু শোক-মিছিলে হাঁটতে ও মোমবাতি জ্বালাতেই ঝাড়খণ্ডের গিরিডি থেকে এসেছেন শ্যামকুমার সিংহ। শ্যামকুমার আমরি দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন দিদি ববিকে। শ্যামকুমার বলেন, “মোটরবাইক দুর্ঘটনায় দিদি আহত হয়েছিলেন। শুনেছিলাম, কলকাতায় আমরি হাসপাতালে চিকিৎসা ভাল হয়। তাই গিরিডি থেকে দিদিকে এখানে ভর্তি করেছিলাম। দিদি সুস্থও হয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু তার পরে কী যে ঘটে গেল।” |
ওই মিছিলে হাঁটছিল তিন বছরের ছোট্ট ঋষিরাজ। তার মা মুনমুন চক্রবর্তীকে সে হারিয়েছে আমরির আগুনে। ঋষিরাজ জানে না কেন সে মিছিলে হাঁটছে। শুধু একটা মোমবাতি হাতে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার বাবা শুভাশিসবাবু ছেলেকে কোলে নিয়ে বললেন, “ও ওর ঠাকুমার সঙ্গে চলে এসেছে। এখনও জিজ্ঞেস করে, মা কোথায় গিয়েছে। আমাদের কাছে কোনও উত্তর নেই।”
মৌন মিছিলটা আমরি থেকে সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ সোজা চলে এলো রবীন্দ্র সরোবরের সাফারি পার্কে। ওই পার্কে আমরির ঘটনার মৃত ব্যক্তিদের স্মৃতির উদ্দেশে একটি বেদি করা রয়েছে। ওই বেদির চারপাশে এ দিন সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বাললেন স্বজন হারানো মানুষেরা। সেখানে তাঁরা ফের প্রশ্ন তুললেন, কেন আগুন লাগার দু’ঘণ্টা পরে দমকলকে খবর দেওয়া হল? কেন সে দিন পঞ্চাননতলা বস্তির ছেলেদের উদ্ধার করতে ঠিক সময়ে ঢুকতে দেওয়া হল না? নানা অনিয়ম থাকা সত্ত্বেও আমরির মতো বড় হাসপাতাল নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিনের পর দিন কী ভাবে চলছিল? গত এক বছরে এর কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ দিনের সাফারি পার্কের মোমবাতি জ্বালানোর অনুষ্ঠানে ছিলেন পুর ও নগরোন্নায়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও। স্বজনহারানো মানুষেরা মন্ত্রীকে অনুরোধ করলেন, সাফারি পার্কের এই স্মৃতি বিজরিত বেদিকে শ্বেতপাথরের স্থায়ী বেদীতে পরিণত করতে। মন্ত্রী তাতে সম্মতি দিলেন। সেই সঙ্গে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক ‘রোগী সুরক্ষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে সরকারকে উদ্যোগী হতেও অনুরোধ জানান তাঁরা। দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তিরও দাবি উঠল। ফিরহাদ বলেন, “আইনি প্রক্রিয়া আইন মেনেই চলবে। সরকারের তরফে গাফিলতি হবে না। তবে আমরির ঘটনায় সরকার সব সময়েই স্বজন হারানো মানুষদের সঙ্গে রয়েছে ও থাকবে।” |