বিবাহবিচ্ছিন্না। একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। আর একটি কন্যা হয়েছে সম্প্রতি। লালবাগের এক তরুণী সেই সদ্যোজাত কন্যাকে এক নিঃসন্তান দম্পতির হাতে তুলে দিয়েছেন। সেই দম্পতি তাঁকে এক হাজার টাকাও দিয়েছে।
কিন্তু এ ভাবে কি সন্তান ‘দান’ করা যায়?
ওই মহিলার দাবি, তিনি খুবই দরিদ্র, মেয়ে যাতে ভাল ভাবে মানুষ হতে পারে, সেই জন্যই তিনি ‘দান’ করেছেন। ওই দম্পতির দাবি, তাঁরা ওই সদ্যোজাতকে নিজেদের কন্যার মতোই মানুষ করবেন। কিন্তু এই ভাবে ‘দান’ করা বা দত্তক নেওয়া যায় না। এর ফলে ওই সদ্যোজাতের আইনানুগ পরিচয় নিয়েও সমস্যা হতে পারে। মুর্শিদাবাদ চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারপার্সন সিরাজুল ইসলাম বলেন, “এই ভাবে দত্তক নিলে ওই সদ্যোজাতকে আইনানুগ ভাবে নিজেদের সন্তান বলে স্বীকার করতে পারবেন না ওই দম্পতি। তাতে ওই কন্যারই ক্ষতি। তাই উচিত ছিল, নিয়ম মেনেই মেয়েটিকে দত্তক নেওয়া।”
সেই নিয়ম কী? সিরাজুল বলেন, “আগে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির মাধ্যমে দত্তক নেওয়া যেত। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট অ্যাডপসন রিসোর্স এজেন্সির অধীনে স্পেশাল অ্যাডপসন এজেন্সি (সা) খোলা হয়েছে। মালদহ জেলায় তার কার্যালয় রয়েছে। এখন কেউ সন্তান দত্তক নিতে চাইলে বা দিতে চাইলে সেই দম্পতিকে ‘সা’-তে নাম নথিভুক্ত করতে হবে।” সেই সঙ্গেই তিনি বলেন, “মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে পাওয়া শিশুসন্তান জেলারই কোনও দম্পতিকে দেওয়ার কথা সা-কে জানানো হয়েছে।” তবে ওই তরুণী ও যে দম্পতির কাছে তিনি তাঁর সন্তানকে ‘দিয়েছেন’, তাঁরা কেউই অবশ্য এই নিয়মের কথা জানেন না। লালবাগের কুর্মিতলার বাসিন্দা ওই তরুণীর কথায়, “আমি এ সব নিয়ম জানতামই না।” বিবাহবিচ্ছেদের পরে তিনি থাকেন তাঁর মায়ের কাছে। তাঁর বক্তব্য, “অভাবের সংসার। আমি ও আমার দুই সন্তানের খাওয়া খরচ মা চালাতে পারবে না। নিজের সন্তানকে তো ফেলে দিতে পারি না! তাই যাদের ছেলেমেয়ে নেই, এমন কাউকে বাচ্চা দিয়ে দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।”
সে কথা জানতে পারেন কুর্মিতলারই এক যুবক। তাঁর কাছ থেকে খবর পান দৌলতাবাদ থানার ন-মাইলের কাপড় ব্যবসায়ী অমল মণ্ডল। অমলবাবু বলেন, “বিষয়টি আমি তখন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা আমার এক বন্ধুকে জানাই। ওই বন্ধুর এক নিঃসন্তান দিদি রয়েছেন, তিনিই ওই বাচ্চা পালনের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেন। সেই মতো আমি দু’পক্ষকেই টেলিফোন নম্বর দিয়েছিলাম। তারা কথা বলে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেয়।” শান্তিপুর থানার ফুলিয়ার বাসিন্দা কানাই দেব বলেন, “আমার এক নিঃসন্তান দিদি রয়েছেন। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি ও তাঁর স্বামী সন্তান দত্তক নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। লালবাগের ওই তরুণী স্বেচ্ছায় সন্তান দিতে চান শুনে আমরা আগ্রহী হই। এর পরে টেলিফোনে কথা বলে লালবাগে গিয়ে ওই সদ্যোজাত কন্যাসন্তান নিয়ে আসি। কিন্তু নিয়মের কথা আমরা কিছু জানতাম না।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দিল্লির বাসিন্দা এক যুবকের সঙ্গে আড়াই বছর আগে নমিতাদেবীর বিয়ে হয়। তাঁদের এক কন্যাসন্তান রয়েছে। ওই তরুণী বলেন, “স্বামীর সঙ্গে বছর খানেক আগে আমার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে।” গত ৩ ডিসেম্বর বাড়িতেই তাঁর সন্তান হয়। তার পরে সেই সন্তানকে ওই দম্পতির হাতে তুলে দেন। এই সময়েই তিনি প্রসবকালীন সমস্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। রবিবার সকালে তাঁকে লালবাগ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। এর পরেই সন্তান দিয়ে দেওয়ার কথা জানাজানি হয়ে যায়। খবর পেয়ে তদন্ত শুরু করে মুর্শিদাবাদ থানার পুলিশ।
ওই মহিলা তাঁর সন্তান ‘বিক্রি’ করে দিয়েছেন কি না, সেই প্রশ্নও ওঠে। তবে তিনি নিজে তা অস্বীকার করে বলেন, “আমি মেয়েকে বিক্রি করিনি। ওই দম্পতি নিজে থেকেই আমার বড় মেয়ের হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছেন, এই পর্যন্ত।”
মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (লালবাগ, মুর্শিদাবাদ) মৃণাল মজুমদার বলন, “ওই মহিলা তাঁর সদ্যোজাত সন্তান এক নিঃসন্তান দম্পতিকে দিয়েছেন বলে শুনেছি। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে ওই মহিলা অসুস্থ হয়ে লালবাগ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ফলে তাঁকে জেরা করে প্রকৃত ঘটনা জানা যাচ্ছে না।” পুলিশ জানিয়েছে, ওই দম্পতিকে সন্তান সহ মুর্শিদাবাদ থানায় আসতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ওই কন্যা সন্তানকে তার মায়ের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া হবে। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, যদি সেই মহিলা তাঁর কন্যাকে কারও হাতে দত্তক দিতে চান, তাহলে আইন মতোই চলা হবে।
কিন্তু দত্তক দেওয়ার নিয়ম নিয়ে আইনি সচেতনতার অভাব কেন? মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক সন্দীপকুমার দত্ত বলেন, “আমাদের কিছু খামতি রয়েছে। আমরা চেষ্টা করব জেলার সর্বত্র এই সচেতনতা বাড়াতে। যাতে কেউই আর এই সমস্যার মধ্যে না পড়েন।” |