|
|
|
|
|
|
|
একটাভয়কষ্টলজ্জাঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
|
সময়টা নব্বইয়ের গোড়ার দিক। তখন ডিটিপির খুব রমরমা। লিট্ল ম্যাগাজিনেরও। অফবিট বাঙালি তরুণ, এমনকী বাংলা সাহিত্যেরও ভারী দর ছিল। এই ক্ষেত্রে ডিটিপি আর লিট্ল ম্যাগাজিনের যোগ গাঢ়। ইতিহাস জুড়ে লিট্ল ম্যাগাজিনের দুর্দশা চলে আসছে। পয়সার অভাবে তারা বাঙালির সেরা সাহিত্য পাতে পাতে বেড়ে দিতে পারে না। আমাদের গল্পে, এক দরাজ সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুর ডিটিপির দোকানে প্রায় নিখরচায় বন্ধুদের লিট্ল ম্যাগাজিন ছাপা হয়। সদাহাস্যময় ডিটিপি ব্যবসায়ী বন্ধু পরম আনন্দে লিট্ল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীকে সাহায্য করে চলে। এখন ছাপো, পরে, অনেক পরে, পারলে পয়সা দাও, না পারলেই বা কী, থাক না ও সব প্রসঙ্গ এই পলিসি নিয়ে সে কাজ করে। নিজে লেখে না, অন্যদের লেখা ভীষণ মন দিয়ে শোনে। চার পাশে বন্ধুদের মধ্যে ধন্য ধন্য পড়ে যায়, ব্যবসাটা সে খুলেইছে লাভ করার জন্য নয়, লোকসান করেও বাংলা সাহিত্যের সেবা করবে বলে। কেউ তাকে ইয়ার্কি মেরে বলে ‘এখনকার ডি.কে.’, কেউ আদর করে বলে, ‘তোর কন্ট্রিবিউশন যে কোনও লেখকের চেয়ে বেশি!’
এমনই এক দিন লিট্ল ম্যাগাজিনের এক বন্ধু ডিটিপির দোকানে হাজির। ডিটিপি বন্ধুর ছোট অফিসের পাশেই একটা বড় অফিস, কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা যায় সেখানে বেশ এক জমজমাট অবাঙালি ব্যবসায়ী তাঁর নিত্য কাজ সারেন। এই অবাঙালি সম্প্রদায়টিকে বাঙালিরা সাধারণত ঘোরতর অপছন্দ করে। তার ওপর আবার এই ব্যবসায়ী ভীষণ মোটা। ও দিকে বাঙালির চিত্তে হেবি রাগ, রোজ আমাশা, কম মাইনে, পচা ফুলকপি, বাথরুমে লোক, সব মিলিয়ে সে জেরবার। আর সেই দলাপাকানো রাগগুলো হুটহাট কোনও প্রায়র ইনফরমেশন ছাড়াই বেরিয়ে আসে। এই দিনটিতেও সেই কবি বন্ধুটির মেজাজ কেন কে জানে খুব খিঁচড়ে ছিল। কাচের মধ্যে দিয়ে অবাঙালি মানুষটিকে দেখেই তার বাঁধ ভেঙে গেল। রাগের পুঁটুলি থেকে সেই সম্প্রদায়ের প্রতি সে বাছা বাছা বোমাবর্ষণ করতে লাগল। মানে, সরাসরি তাঁর কানে যাবে এমন ভাবে নয়, এই ডিটিপি বন্ধুটির কাছে, ফিসফিস করে, কিন্তু বিষ মাখিয়ে। ‘দ্যাখ শালা, এই অমুকরা কলকাতাটাকে নষ্ট করে দিল, গাঁউ গাঁউ করে খায় আর মোটা হয়, পাছা দেখেছিস, গড়ের মাঠেও ধরবে না, আর গুটখা খেয়ে ওয়াক থু ওয়াক থু করে সারা কলকাতাকে প্রিন্টেড করে দিল, ওরাই সব টাকা লুটে নিয়ে বাঙালিগুলোকে ভেড়ুয়া বানিয়ে দিল, ওদের জন্যেই শালা বাঙালির কিছু হল না, ওদের জন্য আমরা চিরকাল সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হয়ে রয়ে গেলাম, দেখিস এক দিন বাঙালি ভার্সেস এই জাতটার দাঙ্গা হবে। সব কটাকে ঠাটিয়ে মেরে তাড়ানো দরকার...’
ডিটিপি ব্যবসায়ী স্মিত মুখে সব শুনতে থাকে। এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগব লাগব সময়ে অন্য এক বন্ধুর প্রবেশ। সে তো এ সব শুনে স্তম্ভিত। সে পড়িমড়ি উত্তেজিত বাঙালিকে শান্ত করতে চায়। কিন্তু কে কার কড়ি ধারে? শেষ কালে প্রায় জোর করে তাকে বের করে নিয়ে আসে অকুস্থল থেকে। এবং তার পর এক গাল মাছি। কাচের ঘরের মোটা ব্যবসায়ী আর কেউ নন, ডিটিপি বন্ধুর বাবা। মানে? হ্যা। এত দিন অজানা ছিল যে, গড়গড়িয়ে ঝরঝরিয়ে বাংলা বলা, বাংলায় আড্ডা মারা, বাংলায় খিস্তি করা, বাংলা সাহিত্যপ্রেমী, লিট্ল ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠপোষক ছেলেটিও আসলে ওই সম্প্রদায়ের। |
|
|
|
|
|