|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন
|
জার্মান কাহিনিকার হাইনরিশ ব্যোল একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন কার্ল মার্ক্সের ওপর। প্রবন্ধটি মার্ক্স ও তাঁর দর্শনের ওপরেও নয়, বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে মার্ক্সীয় চিন্তার প্রভাবের ওপরেও নয়। ব্যোল লিখেছিলেন ফ্রিডরিশ এঙ্গেলসের সঙ্গে কার্ল মার্ক্সের বন্ধুতার ওপর। মার্ক্সের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস সারা জীবন তাঁর বন্ধুর চিন্তাধারার স্মৃতি যে কী যত্নে রক্ষা করে গিয়েছিলেন তার ওপর। সত্তরের দশকে তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে থাকার সময় ওই প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছিল আধুনিক বাংলা গানের জগতে আমার জানা এক বন্ধুতার কথা। সুধীরলাল চক্রবর্তী ও নিখিলচন্দ্র সেনের বন্ধুতা। সুধীরলাল তার অনেক আগেই প্রয়াত। নিখিলচন্দ্র তখনও বেঁচে। আমার বাবার বিশিষ্ট বন্ধু, আমাদের বাড়ির নিয়মিত অতিথি, বাবার চেয়ে বয়সে একটু বড়। ১৯৫৫ সালে আমার জন্মস্থান কটক থেকে কলকাতায় চলে আসার পরেই নিখিলচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয়। সুধীরলাল মারা যান পঞ্চাশের দশকেই। অকালে মারা যান। রেখে যান উৎপলা সেন, শ্যামল মিত্র, নীতা সেনের মতো ছাত্রছাত্রীদের। আরও অনেক প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন তরুণ-তরুণী সুধীরলালের কাছে গান শিখতেন। সকলের নাম আমার জানা নেই। সে সময়কার সুধীরলাল-ঘরানার খবর পুরোপুরি রাখতে হলে আমার বয়স এখন অন্তত আশি হওয়া দরকার ছিল। এই শহরে গানবাজনার এমন মানুষ এখনও আছেন, যাঁদের বয়স আশি বা তার কাছাকাছি। তাঁদের কেউ কেউ কি আর সুধীরলালকে চিনতেন না, তাঁর সম্পর্কে জানতেন না? তাঁর মৃত্যুর পর ছ’টি দশক কেটে গিয়েছে। ক’জন প্রকাশ্যে ক’বার বলেছেন তাঁর কথা? ক’টি পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে? সুধীরলালের একটি গানও খাতা না দেখে গাইতে পারার মতো ক’জন আছেন এই রাজ্যে? সংগীতে যাঁরা সমাজের অভিভাবক হতে পারতেন, তাঁদের বেশির ভাগ নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। কেউ কেউ আবার নেতামুখাপেক্ষী। ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা’। সমাজের অপেক্ষাকৃত নবীনদের কাছে তাঁরা রেখে যান বড় জোর স্তাবকতার স্মৃতি।
মায়ের কাছে শুনেছিলাম কলকাতায় উৎপলা সেনের একটি অনুষ্ঠানের কথা সে কালের নামজাদা রূপসী, ‘মিস বেঙ্গল’। উৎপলা তখন সবে ঢাকা থেকে কলকাতায় এসেছেন। তিনি গাইছেন তাঁর গুরু সুধীরলালের সুরে ‘এক হাতে মোর পূজার থালা/ আর এক হাতে মালা/ মন যা চাহে নাও, তোমার মন যা চাহে নাও’। জানি না, কে লিখেছিলেন এমন গান। নিজে অল্পস্বল্প গান লিখতে চেষ্টা করেছি, ভাল পারিনি। এ রকম তিনটি লাইন যদি লিখতে পারতাম আর অমন সুর যদি দিতে পারতাম! মা বলেছিলেন, মঞ্চ আলো করে গান গাইছিলেন সে যুগের উৎপলা, আর হারমোনিয়ম বাজাচ্ছিলেন সুধীরলাল নিজে। কলকাতার বড় জলসায় শ্রোতাদের সামনে গুরুই প্রথম হাজির করছেন তাঁর পয়লা নম্বর ছাত্রীকে। |
|
উৎপলা সেন ও শ্যামল মিত্র তাঁদের সংগীতজীবনের গোড়ার দিকে সুধীরলালের সুরেই আধুনিক বাংলা গান রেকর্ড করেছিলেন। আমার জ্ঞান সীমিত। যত দূর জানি, সুপ্রভা সরকার রেকর্ড করেছিলেন সুধীরলালের এক আশ্চর্য সুর ‘তোমারে পারি না ভুলিতে’। সুধীরলাল বেঁচে থাকলে তাঁর সুরে আরও গান নিশ্চয়ই গ্রামোফোন রেকর্ডে স্থান পেত তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠে তো বটেই, অন্য শিল্পীদের কণ্ঠেও।
পঞ্চাশের দশক ও ষাটের দশক ছিল সুর ও গায়কির দিক দিয়ে আধুনিক বাংলা গানের রমরমার যুগ। বাংলা চলচ্চিত্রে আধুনিক বাংলা গান বিচিত্র বিকাশের সুযোগ পেয়েছিল ওই সময়ে। ছবি বলে আমায় দ্যাখ, ছবির গান বলে ধুৎ, দেখবি কী? আমায় শোন। সুধীরলালের অকালমৃত্যুর ফলে রসোত্তীর্ণ অন্যান্য আধুনিক বাংলা গানের চাপে তাঁর গানগুলির স্মৃতি হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে হারিয়েই যেত। সেই ক্ষতির হাত থেকে আমাদের বাঁচালেন সুধীরলালের বন্ধু নিখিলচন্দ্র সেন।
প্রয়াত সংগীতকার-বন্ধুর স্মৃতিতে নিখিলচন্দ্র সম্পূর্ণ নিজের খরচায় ও উদ্যোগে প্রতি বছর একটি অনুষ্ঠান করতেন কলকাতায়। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৫৭ সালে, আমার বয়স তখন আট, সুধীরলাল-স্মৃতিবাসরে প্রথম যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। নিখিলচন্দ্র প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতেন, তাই জানি, সুধীরলালের সঙ্গে তাঁর বন্ধুতা শুরু হয়েছিল ঢাকায়, দেশভাগের অনেক আগেই। নিখিলচন্দ্র নিজেও ছিলেন প্রশিক্ষিত সুগায়ক। কলকাতায় চলে আসার পর তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের আধুনিক গান ও ভক্তিগীতির শিল্পী হয়ে ওঠেন। সুধীরলালের গলা ছিল সরুর দিকে। পাশ্চাত্যের হিসেবে বলা যায় ‘টেনর’। দুর্দান্ত তৈরি। তাঁর সুরে যে সূক্ষ্ম কাজগুলি থাকত, ক্ষিপ্রগতি ছুট্তান ও তান-নির্ভর চলনের যে বৈশিষ্ট্য তাঁর সুরের ধর্ম, সেগুলি তাঁর কণ্ঠে ছিল যেন সহজাত। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিখিলচন্দ্রের কণ্ঠে ছিল কিন্তু ব্যারিটোনের মেজাজ। সেই সঙ্গে ঈর্ষণীয় জোয়ারি। এ-হেন সমন্বয় পঙ্কজকুমার মল্লিকের পর আর পাওয়া যায়নি। গম্ভীর গলায় যেন তানপুরার রিনরিনে আওয়াজ। নিখিলচন্দ্র যখন আমাদের বাড়িতে আপন মনে হারমোনিয়ম বাজিয়ে সুধীরলালের গানগুলিই শোনাতেন, সেই ছোটবেলাতেই মনে হত ইস্, ইনি কেন কিছু গান রেকর্ড করলেন না!
সুধীরলালের স্মৃতিবাসরে শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য নিখিলচন্দ্র প্রত্যেকের বাড়ি যেতেন। অনুষ্ঠানের কয়েক মাস আগে থেকেই তাঁর বাড়ি-বাড়ি যাওয়া শুরু হত। সুধীরলালের কোনও কোনও ছাত্রছাত্রী তখন খুবই নাম করে গিয়েছেন, ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বয়সে নিখিলচন্দ্র সকলের বড়। কিন্তু ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁকে বাবার কাছে কান্নাভেজা গলায় ফিসফিস করে বলতে শুনেছিলাম, ‘বড়দা, এই বয়সে আর পেরে উঠছি না; সুধীরের এই স্মৃতিবাসর করব কী, কেউ কেউ এত বড় হয়ে উঠেছে যে দেখাই করতে চায় না। বার বার তাদের বাড়ি গিয়ে গলবস্ত্র হতে হয়।’
যত দূর জানি, ছাত্রছাত্রীদের গান শেখানোই ছিল নিখিলচন্দ্রের উপার্জনের প্রধান, সম্ভবত একমাত্র উপায়। তাঁর সমবয়সি বা তাঁর চেয়ে বয়সে কিছু ছোট কোনও কোনও শিল্পীর মতো জলসা-জনপ্রিয় তিনি কোনওদিনই হয়ে ওঠেননি। আকাশবাণীর অনুরোধের আসরে তাঁর কোনও রেকর্ড কখনওই বাজেনি। তাঁর বন্ধু সুধীরলালের একাধিক গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল। তাঁর নিজের কোনও রেকর্ড ছিল বলে শুনিনি। আকাশবাণীতে গান গেয়ে কত টাকাই বা মিলত? অর্থাৎ, সীমিত আয় থেকেই তিনি প্রতি বছর সুধীরলালের স্মৃতিবাসরের আয়োজন করতেন। প্রত্যেক শিল্পী গাড়িভাড়া পেতেন। কেউ তা না নিলে সেটা অন্য কথা।
১৯৫৭ সাল থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝির পর পর নিখিলচন্দ্র সেন কবে গত হয়েছেন জানি না। আমি প্রবাসে থাকার কোনও এক ফাঁকে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সুধীরলালের নিখিল ছিলেন। নিখিলের? |
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|