|
|
|
|
|
|
চেনা গল্প অচেনা মোচড় |
আজ কপাল পুড়ল: শোলে-র |
শান্তনু চক্রবর্তী |
রামগড়ের পাথুরে রাস্তায় বাসন্তীর টাঙ্গা খুব ছুটছে। ঘোড়ায় চেপে তাড়া করেছে গব্বর-ব্রিগেড। ওরা গুলি চালাচ্ছে। টাঙ্গার পিছনে বসে জয় আর বীরুও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। আর টাঙ্গার ভিতরে ঘোমটা টেনে জড়সড় বসে আছে রাধা। বাসন্তী টাঙ্গা ছোটাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে ‘চল্ ধন্নো’। বীরু বন্দুক চালাচ্ছে আর মুখ ছোটাচ্ছে এক এক কো চুন্ চুন্ কে মারুঙ্গা। আচমকা একটা পাথরে চাকা আটকে গিয়ে টাঙ্গাটা উল্টে যায়। বাসন্তী আর বীরু, রাধা আর জয় পাহাড়ের ঢালে দু’দিকে গড়িয়ে যায়। গব্বরের লোকেরা হইহই করে দৌড়ে আসে। |
|
ফ্ল্যাশব্যাক
খটকাটা ক’দিন ধরেই মনের ভেতর বারান্দায় জুতো পায়ে খটখটিয়ে হাঁটছিল। আর ছটফটিয়ে মরছিলেন বেচারা ‘ঠাকুরসাহেব’। হাভেলির অন্দরে বাইরে কিছু যে একটা ঘটছে, বেশ টের পাচ্ছিলেন। ছোট বহুরানির হাবভাব যেন কেমনধারা। আগে ঠাকুরসাহেবকে লম্বা বারান্দার ওই মুড়োয় দেখলে একগলা ঘোমটা টেনে দেওয়ালের গায়ে লেপ্টে, ঘেঁষটে দাঁড়িয়ে থাকত। আর আজকাল মাথায় কাপড় রইল কি রইল না, শ্বশুরমশাইয়ের পাশ কাটিয়ে বউমা আমার তড়বড়িয়ে আগেভাগে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে। ঘরের কাজেও এটা-সেটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। হবে না? শ্যামের বাঁশি ডেকেছে যে! বাঁশি তো নয়, মাউথ অর্গান! শালা ওই জয়! হারামির হাতবাক্স একটা। রামলাল বলছিল, রোজ রাতে আউটহাউসের খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে উঠোনের ধারে এসে ওই শুয়োরের বাচ্চাই মাউথ অর্গানে ফুঁ দেয়। আর বউমা তক্ষুনি পড়ি কি মরি করে এক ছুটে বারান্দায়, তার পর সিঁড়ি বেয়ে তড়বড়িয়ে নীচে। বারান্দার সব আলো নিভিয়ে দু’জনে নাকি কত রাত অবধি গল্প করে। সুখ-দুঃখের কথা বলে। রামলাল শুনেছে। বউমা বলে তার ছোটবেলার কথা, তার গ্রাম, দস্যিপনা, বাবা-মা। ঠাকুরসাহেবের ছেলের সঙ্গে দুম করে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়া তার পর এই বিধবার সাদা শাড়ি। জয়ও বলে পুলিশের তাড়া খেতে খেতে, বড় বড় ছেলেদের হাতে হেনস্থা হতে হতে, ফুটপাথে ওর একলা বেড়ে ওঠার গল্প। অমন গোঁজপানা মুখের ঢ্যাঙা লোকটা যে অত কথা বলতে পারে কে জানত! রামলাল দেখেছে, জয় যখন এই সব বলে, ছোট বউমার চোখ দুটো নাকি ছলছল করে। আদিখ্যেতা! তুই চোখে ন্যাকা-ন্যাকা করে জল আনলেই উল্টো দিকের হারামিটারও হাত খলবল করবে সেই জলটা চুক করে মুছিয়ে দেওয়ার জন্য। রামলাল তো শুনেইছে, জয় ওর হেঁড়ে গলাটায় মধু ঢেলে বলছে রো মৎ রাধা। আই হেট টিয়ার্স! শালা যেন রাজেশ খান্নার বাচ্চা। জন্মের ঠিক নেই, ঠাকুরবাড়ির বউকে নাম ধরে ডাকছিস! ‘লভ্ মারাচ্ছিস, লভ্!’ ঘুমের ঘোরে ঠাকুরসাহেবের দাঁত কিড়মিড় করে।
কিন্তু জয়-রাধার প্রেম-কাহিনি তো আর শুধু যশ চোপড়া ব্যানারের ‘ইউ’ মার্কা ফ্যামিলি রোমান্সের স্ক্রিপটে আটকে থাকছে না। পরশু রাত্তিরে ঠাকুরসাহেব নিজের চোখে যা দেখলেন...কী ঘেন্না, কী ঘেন্না! ছোট বউয়ের গায়ে শাড়ি-ব্লাউজ ঠিকঠাক নেই, আর জয়ের আদুল বুকের ওপর হামলে পড়ে সে হাপুস-হুপুস হামি খাচ্ছে। মেঘের মতো খোলা চুলে ফর্সা পিঠের অনেকটা ছেয়ে আছে। সাদা শাড়ির আড়ালে এতখানি তাপ লুকিয়ে রেখেছিল মেয়েটা! ঠাকুরসাহেব টেরই পাননি? মাসের দু-একটা দিন গোসলখানার মেঝেতে মাঝেমধ্যে দু-এক ফোঁটা রক্তের দাগ দেখেছেন বটে। কিন্তু সেই রক্তের ফোঁটায়-ফোঁটায় একটা মেয়ের এতখানি কামনা ইচ্ছে চটচট করছিল, কে জানত! ওই জন্যেই বেরাদরির লোকেরা বলেছিল, কাঁচা বয়সের বেধবা-রাঁড়, বাড়িতে রেখো না। কবে কখন বংশের গায়ে চুন-কালি দেবে, টেরও পাবে না। বাপের বাড়ি না পাঠাও, মাথাটা অন্তত মুড়িয়ে দাও। চুলের বাহার, রূপের দেমাক গেলে গতরের গরমটাও কমবে।
ঠাকুরসাহেব তখন দরদ দেখিয়ে রাধাকে মেয়ের মতো কাছে রেখে দিলেন, এখন দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে। শরীরের সমস্ত ক্ষত্রিয় রক্ত যেন মাথায় এসে জমেছে। কী করবেন এখন? ইচ্ছে তো করছে এক লাথিতে দরজা ভেঙে ঢুকে এক্ষুনি বন্দুক চালিয়ে দুটোকেই সাবড়ে দেন। কিন্তু কী করে? নিশপিশ করার মতো হাত দুটোও তো তাঁর নেই। ছেনাল মাগিটার চুলের মুঠি ধরে দুটো থাপ্পড় কষাবেন, সেটুকু অওকত্-ও নেই! মেরে হাত মুঝে লৌটা দে গব্বর...! গব্বর। গব্বর! আচ্ছা গব্বরই তো পারে এই লজ্জা, এই বদনামির হাত থেকে তাকে বাঁচাতে। হ্যাঁ, গব্বর বাগি-ডাকু। ঠাকুরসাহেবের সঙ্গে তার কয়েক পুরুষের জাত-ই দুশমনি। তো তার বদলা তো তুই নিয়ে নিয়েছিস গব্বর। আভি তো ঠাকুর বংশের ইজ্জত কা সওয়াল। নিজে ঠাকুর হয়ে নিজের জাতের লোককে দেখবে না গব্বর? গব্বর-রাজ খতম করতে ওই দুটো শহুরে লাফাঙ্গাকে রামগড়ে এনেছিলাম রামগড়কে বাসিয়োঁ, দ্যাখো ওই দুটো কুত্তা এখন রামগড়ের বহুবেটির ইজ্জত নিয়ে খেলছে! আমি তাই এ বার গব্বরকেই সুপারি দিচ্ছি জয় আর বীরুকে নিকেশ করে দিক, সেই সঙ্গে আমার ওই কুলটা ছোট বউমাকেও! ‘অনার কিলিং’ বোঝো, ‘অনার কিলিং’? শরীরের গরমে যারা কুলের মুখে কালি দিয়েছে, তাদের কেলিয়ে-খুঁচিয়ে-কেটে-কুপিয়ে-পুঁতে-ঝুলিয়ে দাও। রামলাল, রামলাল! কোথায় থাকিস, গব্বর সিং-এর কাছে যেতে হবে এখুনি!
|
ফ্ল্যাশ ফরওয়ার্ড
রামগড় স্টেশন। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে। বীরু আর বাসন্তী এই মাত্র হাঁপাতে হাঁপাতে ট্রেনে উঠল। অন্ধকার একটা কুপে বেছে যেই ঢুকতে যাবে, ভেতর থেকে টং করে একটা কয়েন উড়ে এসে বীরুর পায়ের সামনে পড়ল। তার দু’দিকেই রাজার মাথা। বীরু বুঝে গেল, টস করেই ঠিক হবে এই রাতে কুপেটা কার দখলে থাকবে বীরু-বাসন্তী, না জয়-রাধা।
|
এন্ড টাইট্ল
জয়, বীরু, রাধা, বাসন্তী গেরিলা ফাইট চালিয়ে পালাতে পারলেও, এলাকায় গব্বর-রাজ যেমন ছিল তেমনই চলছে। তবে ডাকুগিরি ছেড়ে গব্বর নেতাগিরি ধরেছে। সে এখন এম পি। আর ঠাকুরসাহেব তার ইলেকশন এজেন্ট। আবার খাপ-পঞ্চায়েতের সরপঞ্চ। রামগড়ে গত দেড় বছরে আট জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশ বলছে, সব ক’টাই নাকি আত্মহত্যার কেস! |
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
|
|
|
|
|
|