এক দিকে তালপাটি খাল ও অন্য দিকে হুগলি নদী। তারই কোল-ঘেঁষা বনবাদাড় গাছপালায় ঘেরা ছোট্ট গ্রামে থাকে রান্টি। সে শুনেছে যারা শহরের স্কুলে পড়ে তারা নাকি স্কুলে যায় গাড়িতে চেপে। গ্রামের মাঝে একটা স্কুল। সে হেঁটে যায়, একা নয়, বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে। তার হাঁটতে বেশ ভাল লাগে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় গাছপালা যেখানে দূরে আকাশকে ছুঁয়ে আছে সেখানে গেলে বেশ মজা হবে।
তার মা বলেছেন, স্কুলের ছুটির পরে সোজা বাড়ি চলে আসবি অন্য কোথাও যাবি না।
ছেলেধরা আছে।
সন্ধে হলে প্রতিদিন পড়তে বসতে হয় রান্টিকে। আজ সন্ধের আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মনে মনে সে বলল, আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে। মাছগুলো সারা বছর বন্দি থাকে পুকুরে। ইচ্ছে মতো নদী বা খালবিলে গিয়ে মনের সুখে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পায় না। বৃষ্টি হলে দারুণ মজা। মাঠঘাট-পুকুর ডুবে রাস্তায় জল থইথই করে। তখন ওরা স্বাধীন।
ছিঁচকাঁদুনে মেঘগুলো খুব বিচ্ছু। সকাল হতেই কান্না থামিয়ে দিল। আকাশ পরিষ্কার। তাই রান্টি স্কুলে যাচ্ছে। বিলু এসে বলল, রান্টি তাড়াতাড়ি চল। দেরি হয়ে গিয়েছে। স্যর বকবেন যে। বিলু রান্টির বন্ধু। ওরা একই ক্লাসে পড়ে।
রান্টি মুখ গম্ভীর করে বলল, আজ কিন্তু অঙ্কের স্যরের কাছে বকুনি খাব। হোমটাস্ক করিনি। ভাবলাম আজ রেনি ডে হবে, তাই পরে করে রাখব। তা আর হল না।
তুই তো জানিস আমি অঙ্কে কাঁচা। বকুনি খেয়ে খেয়ে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে।
অনেক সময় অঙ্ক বুঝতে পারি না। কিন্তু অঙ্কের স্যর বকুনি দেন বলেই তো সাহস করে বলতে পারি না।
ইংরেজির স্যর খুব ভাল। বকেন না। বুঝতে না পারলে বুঝিয়ে দেন। পড়া না করলে রাগ করেন। আমাদের ভালবাসেন।
তাই তাঁর পড়া আগে করি। |
রাস্তায় কাদা। তাই জুতো জোড়া হাতে নিয়ে ওরা হাঁটছিল। স্কুলের সামনে এসে পা ধুয়ে জুতো পরে স্কুলে গেল। রান্টি লক্ষ করেনি অঙ্কের স্যর ক্লাসে এসে গিয়েছেন, তিনি বললেন, হোমটাস্কের খাতা টেবিলের ওপর সবাই রাখো।
রান্টি বাদে আর সবাই খাতা টেবিলের ওপর রাখল। শিক্ষকমশায় বললেন, রান্টি, স্ট্যান্ড আপ। তোমার খাতা দেখছি না তো!
রান্টি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। শিক্ষকমশায় বললেন, ক্লাসে যখন ঢুকি দেখলাম খাতা খুলে কী যেন করছিলে। ভাবলাম অঙ্ক করছ। খাতাটা দেখি।
রান্টি ভয়ে ভয়ে শিক্ষকমশায়ের কাছে গেল খাতা নিয়ে। খাতা খুলে তিনি দেখলেন একটা ছবি আঁকা আছে। পুকুর পাড়ে আম গাছের ডালে দুটো শালিক বসে আছে, সঙ্গে তাদের একটি ছোট্ট বাচ্চা। একটি ছেলে আম গাছে উঠছে, আর একটি ছেলে তার পা ধরে টানছে।
তিনি ধমক দিয়ে বললেন, এই ছেলে দু’টি কে?
রান্টি মাথা নিচু করে বলল, গাছে উঠছে বিলু, পা ধরে টানছি আমি।
শিক্ষকমশায় গম্ভীর হয়ে বললেন, তার মানে?
স্যর, আমগাছের ডালে দুটো শালিক তাদের বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে বসেছিল। বিলু সেই শালিক বাচ্চাকে ধরে আনবে বলে গাছে উঠছিল। আমি তার পা ধরে টেনে রেখেছিলাম।
পা ধরে টেনে রেখেছিলে কেন?
পাখির বাচ্চাকে ধরে আটকে রাখলে সে ও তার মা-বাবা কষ্টা পাবে, তাই।
তোমার জামা-প্যান্ট ভেজা কেন?
শালিকের বাচ্চাটা ভয়ে পুকুরে পড়ে গিয়েছিল। আমি তাকে জল থেকে তুলে তার মা’র কাছে আমগাছের ডালে রেখে এলাম। জলে নেমেছিলাম বলে প্যান্ট-জামা ভিজে গিয়েছে।
অঙ্কের স্যরকে সবাই দেখেছে খুব গম্ভীর। তাঁর ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি বললেন, রান্টি, তুমি ভবিষ্যতে অনেক বড় হবে। নামকরা চিত্রশিল্পী হবে। তোমার জামা-প্যান্ট ভেজা, তাই তোমাকে ছুটি দিলাম।
ক্লাসের শেষে শিক্ষকমশায় চলে গেলেন। ক্লাসের বাইরে এসে বিলু রান্টিকে বলল, আগে জানলে শালিকবাচ্চাকে তার মা-বাবার কাছে রেখে আসতাম। আমাকেও স্যর ছুটি দিয়ে দিতেন। রান্টি বলতে বলতে চলল নয় রেনি ডে তবু ছুটি যাচ্ছি আমি বাড়ি,/তুই দুষ্টু নয় কথা আর আড়ি আড়ি আড়ি!
|