প্রবন্ধ...
এ ভাবেই শিশুমঙ্গল?
জানুয়ারিতে বাংলার অনুরূপ-সাগরিকা, নভেম্বরে অন্ধ্রের চন্দ্রশেখর-অনুপমা, এবং এই দুই পরিবারের দুটি করে সন্তান: মোট আট জন। নিজেদের লণ্ডভণ্ড জীবন দিয়ে এঁরা গুরুতর ক’টি প্রশ্ন তুলে দিলেন। সকলেই এন-আর-আই, অস্থায়ী নরওয়ে-বাসী। নরওয়ের কল্যাণ-রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ চাইল্ড প্রোটেকশন সার্ভিসেস বা সি পি এস-এর দাপটে আজ প্রথম দম্পতির দুই সন্তান দেশে ফিরেও তাদের মা বা বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং দ্বিতীয় দম্পতি নরওয়ের জেলে যাওয়ায় তাদের দুই সন্তান অপরিচিত এক নরওয়েজীয় পরিবারের জিম্মায়।
প্রথম ক্ষেত্রে অভিযোগ: সাগরিকা তাঁর তিন বছরের সন্তানকে হাত দিয়ে খাওয়াতেন, প্রয়োজনের বেশি খাওয়াতেন, অনুরূপ তাকে নিয়ে এক বিছানায় শুতেন, তার জন্য কম খেলনা কিনতেন, এবং সর্বোপরি, অনুরূপ ও সাগরিকা মাঝে-মধ্যেই ঝগড়া করতেন। স্বভাবতই জলের মতো পরিষ্কার, অনুরূপ-সাগরিকা ‘পেরেন্ট’ হিসেবে অযোগ্য ও বিপজ্জনক সুতরাং কয়েক মাসের ঐশ্বর্য এবং তিন বছরের অভিজ্ঞানকে স্রেফ তুলে নিয়ে যায় সি পি এস। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে তেলুগু দম্পতি চন্দ্রশেখর-অনুপমার অপরাধ আরও জটিল, তাঁদের সাত বছরের ছেলে সাই শ্রীরাম কেবলই প্যান্টে হিসু করে ফেলে, তাই তাঁরা ছেলেকে ভয় দেখান ‘আর এক বার এমনি হলেই সোজা দেশে ফেরত!’ অর্থাৎ হুমকি দেন। অর্থাৎ মানসিক নির্যাতন করেন। সুতরাং বাবার ১৮ মাস ও মায়ের ১৫ মাস জেল সাব্যস্ত অসলো আদালতে, সাত বছরের সাই শ্রীরাম ও তার তিন বছরের সহোদর সটান ফস্টার-কেয়ারের জিম্মায়।
হ্যাঁ, অনেক যুক্তিতর্কের অবকাশ এখানে। তবু প্রথম প্রধান ও প্রবল প্রশ্নটাতেই আসা যাক। অসংবেদনশীল বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়ে বড় করার নামে তাদের ওপর অত্যাচার চালান, শাসনের নামে নির্যাতন চালান, একদম ঠিক। কিন্তু বাবা-মায়ের থেকে সন্তানকে জোর করে আলাদা করে তাদের ভিন্ন দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়ার এই যে পদ্ধতি, এর মধ্যে কোনও নির্যাতন নেই তো, নরওয়ে? বাবা-মা শিশু-অধিকার বিষয়ে মনোযোগী নন বলে অভিযোগ, কিন্তু শিশু-অধিকারের কথা মনে রেখে তাদের অনুমতি বা সম্মতি নিয়েই বাবা-মায়ের থেকে তাদের আলাদা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তো আপনাদের সি পি এ?
অভিজ্ঞানকে তো পার্কে নিয়ে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে লোপাট করা হয়েছিল শিশু-অধিকার অনুসরণ করেই নিশ্চয়ই? ছোট্ট ঐশ্বর্য তখনও মায়ের দুধ খেত, ফলে তাকে আঙুলে করে খাওয়ানোর প্রশ্ন নেই, বেশি খাওয়ানোরও নয়, তাকেও যখন সাগরিকার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল, যথেষ্ট অধিকার-সংক্রান্ত প্রমাণপত্র ছিল নিশ্চয়ই? সাই শ্রীরামের ব্যাপারটা অন্য রকম, সে-ই নাকি স্কুলে গিয়ে বলেছিল, বাড়ি যাব না আজ! তবে সাত বছরের ছেলের মুখের কথা আর মনের কথার মধ্যে যে বহু যোজন দূরত্ব থাকে, এবং তার আজকের কষ্ট আর কালকের আনন্দের মধ্যে বেশ একটা গোলমেলে সুসমঞ্জসতা থাকে, এ সব শিশু-মনস্তত্ত্বের কথা তো আপনাদের কল্যাণ-রাষ্ট্র জানেই। সে সব মনে রেখেই তাকে বাবা-মা-হারা করা হয়েছে তো? তার ভাইয়ের হিসুর কোনও খবর যদিও আমরা পাইনি, ধরে নিচ্ছি কর্তারা জানেন যে কোনও সমস্যা না থাকলেও সে-ও দাদার মতোই বাড়ি-বিমুখ, যদিও তার ছোট্টখাট্টো জীবনে এক দিনও সে ‘বাড়ি’ অর্থাৎ ‘মা’ ছাড়া কাটায়নি!
সি পি এ নামক বস্তুটি যে অপরাধী মানসিকতাসম্পন্ন নয়, এ আমরা জানি। শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর ক্ষেত্রে নরওয়ের তুল্য সংবেদী রাষ্ট্র পাওয়া ভার, ‘স্বাভাবিকতা’র কঠিন পরীক্ষায় এক বার ‘পাশ’ করে গেলে বাবা-মায়ের যে পরিমাণ ছুটিছাটা-করছাড় সেখানে, তা তুলনাবিহীন। কিন্তু একটু অন্য রকম, ছাঁচের একটু বাইরে হলেই, এবং সবচেয়ে বড় কথা, একটু অপরিচিত হলেই যদি সমস্ত উদারতা, মহত্ত্ব, কল্যাণ, প্রগতি নিমেষে হাপিশ হয়ে যায়, ঠাণ্ডা শুকনো রুক্ষ কঠিন ব্যবস্থার কাছে মাথা কুটেও এক ফোঁটা জায়গা যদি না মেলে, মানবাধিকার-বিতর্কের প্রবেশও যদি রুদ্ধ থাকে, সেই রাষ্ট্রকে কি ঠিক ‘সুস্থ’ বলা চলে? নরওয়ের পিতামহ-পিতামহীদের প্রত্যেককে নাকি আমৃত্যু বাধ্যতামূলক ভাবে সশরীরে থানায় হাজির হতে হয়, বাৎসরিক আয় বা পেনশনের হিসেব দিতে হয়, যাতে সারা বছর ছুটিছাটায় নাতি-নাতনিদের দেখতে পাওয়ার অনুমতিটুকু পান তাঁরা। খুবই দূরদৃষ্টিপ্রসূত নিশ্চয়ই। তবে ঠিক মানবিক বলা চলে না। খুব সুস্থও বলা চলে কি?
ভয়ের কথা যেটা, ‘কল্যাণ’ ‘অধিকার’ ‘সুষ্ঠু বিকাশ’ ইত্যাদি শব্দের মুখোশে ঢাকা রাষ্ট্রের একটা ভয়ঙ্কর মুখ এর মধ্যে আমরা দেখতে পাই, যে মুখকে ‘লেভয়াথান’ বা হিংস্রশ্বাপদ-মুখ বলার প্রলোভন হয় প্রবল! নাগরিকের জীবন সহজ ও সুস্থ করার নামে অনায়াসে অনাচার এবং হিংসার পথ নেয় যে এই মুখ সেই মুখ।
পশ্চিম বিশ্বের অন্যত্রও শিশুপালনের নিয়মের বেড়াজাল অনেক। ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষরা সেখানেও মুশকিল বোধ করেন। কিন্তু তবু ব্রিটেন আমেরিকার অভিবাসী বা ভিন্সংস্কৃতির পরিবারগুলি জানেন, হাত দিয়ে খাওয়ানো, বাচ্চাকে নিয়ে শোওয়া কিংবা ভয় দেখানোর মতো ঘটনা ঘটলেও এই পরিণতি সেখানে হবে না, কেয়ার-কমিউনিটির উপদেশ, কাউন্সেলিং সেশন, মন-চিকিৎসকের চেম্বার ইত্যাদি নানা পথ না পেরিয়ে আদালতে পৌঁছনো যাবে না, জেলে তো নয়ই। আসলে স্ক্যান্ডিনেভীয় কল্যাণ-রাষ্ট্রেরই একটা বিশেষ সংকট এখানে ধরা পড়ে যায়। নাগরিকের বাইরের জীবন ও ভেতরের জীবনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় নজরদারির ডিগ্রি ও ধরনের মধ্যে যে একটা তারতম্য থাকা উচিত, সেটা এই মডেলে উপেক্ষিত। ঘোর সন্দেহের তির স্বভাবতই ছোটে পুরাতনী সমাজতন্ত্রী ঘরানার দিকে, কেননা এই কল্যাণ-রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহু দিকে চমৎকারা হলেও কিছু ক্ষেত্রে আজও এরা সেই অতি-রাষ্ট্রবাদী সমাজতন্ত্রী ঐতিহ্যের ধারক-বাহক!
আর এই জায়গাটাতেই ঠোক্কর খেয়ে হিমশিম হয় অভিবাসী সমাজ। যতই উন্নত প্রগতিশীল দেশ হোক, যতই মুখে থাক বহু-সংস্কৃতির মহতী বাণী, ইতিহাস ও ভূগোল এই দেশগুলিকে অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত বা অন্য সংস্কৃতির প্রতি সহিষ্ণু হতে শেখায়নি। অন্য দেশের মানুষের সঙ্গে এত কাছাকাছি ঘর করার দরকারও এদের হয়নি। তাই উন্নয়ন, অর্থনীতি কিংবা রাষ্ট্রনীতি দিয়ে এদের সংকটটা পুরোপুরি ধরা যাবে না, আসলে দেশগুলির অসংবেদনশীলতার মূলে আছে সংস্কৃতির ইতিহাস। তবে কি এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছব আমরা যে, নরওয়ের যে সমাজ তৈরি করে অ্যান্ডার্স বেহ্রিং ব্রেভিক-এর মতো ঠান্ডা মাথার ঘাতক, বহু-সংস্কৃতিবাদ ও অভিবাসী-বিরোধিতার জন্য বন্দুক তুলে ফটাফট যিনি সাবাড় করে দেন শয়ে শয়ে মানুষ, সেই সমাজই আবার এমন রাষ্ট্র বানায়, যার কল্যাণ-নীতির আড়ালে লুকোনো থাকে অসহিষ্ণুতার ভয়াল হিংস্র মুখ, ‘লেভয়াথান’?
অধিকন্তু: ব্যবস্থার মধ্যেকার বাড়াবাড়ি দিয়ে তো আর গোটা ব্যবস্থাটার বিচার হয় না, কল্যাণ-রাষ্ট্রের বাড়াবাড়ি দিয়ে কল্যাণনীতির বিচারও অসম্ভব। তাই সি পি এ-র কাণ্ডকারখানায় অতিষ্ঠ হয়েও স্বীকার করতেই হবে, ব্যবস্থা বা ভাবনা হিসেবে এ এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। প্রতিটি শিশুর প্রতি এই দায়বদ্ধতা: অনুসরণীয় উদাহরণ।
অনুসরণ! কে করবে অনুসরণ? ভারত? ভারত ভাববে তার প্রতিটি শিশুর সুস্থ বৃদ্ধির দিকে লক্ষ রাখার কথা? মজার কথা বটেক। ভারতের শিক্ষা-অধিকার আইনে দৈহিক শাস্তি নিষিদ্ধ, কিন্তু কোথায় প্রয়োগ হয় সে আইন? ভারতে শিশু-অধিকার আন্দোলন দূরস্থান, শিশু-অধিকারের প্রশ্নটি পর্যন্ত ন্যাকামি বলে পরিগণিত। শিশু-শাসন ও শিশু-নির্যাতনের পার্থক্য কী, ভারতীয় বাবা-মা’র মাথা ঘামানোর সময় নেই। আর মানসিক নির্যাতন? ওটা তো স্রেফ আঁতলামি! নরওয়ে-কাণ্ডে আমাদের ঘরে ঘরে এত বিষোদ্গারও তো এই জন্যই! ওদের বাড়াবাড়ির পাশে নিজেদের প্রবল কমাকমি-টা যাতে ফাঁস না হয়, সেটা দেখতে হবে না?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.