সম্পাদকীয়...
সম্মানের ভার
ম্মান কাহাকে বলে তাহা হয়তো কঠিন প্রশ্ন, কিন্তু সম্মান যে এমন কিছু যাহার জন্য নিজ ভ্রাতা-ভগ্নীর বা সন্তানের প্রাণ লওয়া চলে, সে বিষয়ে অনেকেরই আর সন্দেহ নাই। নাদিয়ালের আয়ুবনগরে গত শুক্রবার প্রকাশ্য দিবালোকে এক যুবক তরবারির আঘাতে তাহার বোনের গলাটি কাটিয়া লইয়া ছিন্ন মুণ্ড হস্তে নিজে হাঁটিয়া থানায় গেল ও সমর্পণ করিল, তাহার পর জল খাইতে চাহিল। সে পুলিশকে বলিয়াছে, কাজটি সে ঠিকই করিয়াছে, কারণ তাহার বোন বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত ছিল, তাহাদের পরিবারের সম্মান ধুলায় লুটাইতেছিল। বহু পূর্বের জনপ্রিয় হিন্দি ছবিতে দেখা গিয়াছে, পরিবারের অপছন্দের পাত্রের সহিত মেয়ে পলাইয়া গেলে, ছেলেটিকে মারিয়া ফেলিতে হত্যাকারী প্রেরিত হইত। কিন্তু ব্যাপার ইদানীং এতটা ঘোরালো, সাম্প্রতিক হিন্দি ছবিতে, উক্ত কারণেই, ছেলেটি ও মেয়েটি, উভয়কেই নির্মম কোতল করা হয়। পূর্বে হয়তো ভাবা হইত সম্মান ভাল, কিন্তু নিজ আত্মীয়কে বাঁচাইয়া রাখাও ভাল, ইদানীং তত্ত্বগত বজ্র-আঁটন অধিক কঠোর হইয়াছে, একই অপরাধে পৃথক দণ্ডের ধারণাকে বাতিল করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
পরিবারের সম্মান কাহাকে বলে তাহা কঠিন প্রশ্ন, কিন্তু তাহা যে মূলত পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের অনুমোদিত যৌন সম্পর্কের উপর নির্ভর করে, এই বিষয়ে অনেকেরই সন্দেহ নাই। আশ্চর্য, এই সকল পরিবারের সম্মান কিন্তু ছেলে পরীক্ষায় টোকাটুকি করিলে, ছেলে অন্য সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষকে খুন করিলে, ছেলে ধর্ষণ করিয়া আসিলেও ক্ষুণ্ণ হয় না। অন্তত এমন মাত্রায় হয় না যে শাস্তিস্বরূপ তাহাকে হত্যা করিয়া, অস্তিত্বটাই বিলোপ করিয়া দিতে হয়। কখনও শোনা যায় নাই, ঠাকুরবংশের যে ছেলেটি তাহাদের কূপ হইতে জল লওয়ার জন্য দলিত রমণীকে পিটাইয়া মারিল, তাহাকে তাহার পিতা হত্যা করিয়া পরিবারের সম্মান রাখিল। শিক্ষা, ব্যবহার, নীতি, কিছুর উপরেই সম্মান নির্ভর করে না, কেবলমাত্র কাহাকে তুমি বিবাহ করিতেছ, ইহার উপর করে। তাহার জাত, গোত্র বা গ্রাম-অবস্থান যদি তোমার পিতার বা পঞ্চায়েতের বা চতুষ্পার্শ্বের শাসক গোষ্ঠীর অপছন্দ হয়, তবে উহাকে তোমার বিবাহ করিবার, বা বিবাহ না করিলেও সেই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিবার কোনও অধিকারই নাই। এই ভয়াবহ ও অশিক্ষিত ধারণাটি যে প্রেমকে অসম্মান করে, স্বাধীনতাকে, মানুষের মৌলিক অধিকারকে, সভ্যতাকে অসম্মান করে, তাহাতে এই সতত প্রহারেচ্ছু জনগণের কিচ্ছু আসিয়া যায় না। উহাদের নিকট সমস্যা সমাধানেরও একটিই অকাট্য উপায় রহিয়াছে। তাহা হইল, তরবারিটি কোষ হইতে খুলিয়া, মস্তক লক্ষ্য করিয়া চালনা।
সম্মানের এই বিকৃত ধারণাকে কেমন করিয়া আক্রমণ করা যাইবে? কেমন করিয়া লক্ষ লক্ষ মানুষকে বুঝানো যাইবে, কাহারও কার্য অপছন্দ হইলেই তাহাকে হত্যা করা যায় না, তর্ক করা যায়, ত্যাগ করা যায়, কিন্তু আঘাত করার প্রশ্নই উঠে না? কেমন করিয়া ইহাদের মস্তকে প্রবেশ করানো হইবে, একটি মানুষের জীবন তাহার, অতএব সেই জীবনের মূল সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণের অধিকার তাহার, সিদ্ধান্ত ভুল হইলে তাহার ঝঞ্ঝাট বহন করিবার দায়ও তাহার, ইহার মধ্যে নাক গলানো চূড়ান্ত অসভ্যতা? কে বুঝাইবে, বাহুবল থাকিলেই বিপরীত-মতাবলম্বীকে হত্যা করা যদি সমাধান হয়, তবে তোমার অপেক্ষা বলবান আসিয়া তোমাকে বিপরীত মত লালনের জন্য খুন করিতে পারে? কেবল খাপ পঞ্চায়েত নহে, ‘অবৈধ’ প্রেমের শাস্তি হিসাবে হত্যার নীতিটির প্রতি সমর্থন রহিয়াছে বহু সাধারণ মানুষের। এতগুলি মানুষকে সচেতন করিবার পদ্ধতিটি কী? প্রশাসনের কঠোরতা? শিক্ষার প্রসার? এই ধারণা কেন ভুল তাহা টেলিভিশনে নাট্যরূপ দিয়া প্রচার? এই সবগুলিই? বলা কঠিন। আর এই উত্তরোত্তর হিংসুক সমাজে প্রকৃত সভ্য মানুষের ধারণাবলি লইয়া বাঁচা, কঠিনতর।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.