ভরদুপুরে জনবহুল রাস্তায় ব্যাঙ্ক থেকে হঠাৎ পরপর দু’বার গুলির শব্দ। চিৎকার করতে করতে ভিতর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসছেন কয়েক জন। তবে কি ব্যাঙ্কে ডাকাতের হানা? পাড়ার লোক ও পথচলতি মানুষ ছুটলেন সে দিকে। গিয়ে যা দেখলেন, তা এক কথায় ‘বেনজির’। ব্যাঙ্কের ক্যাশ কাউন্টারের চেয়ারে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে মধ্যবয়সী ক্যাশিয়ার। হাতে টাকার বান্ডিল। বন্দুক হাতে তখনও ঘরেই পায়চারি করছেন ‘আততায়ী’, ব্যাঙ্কের ১৮ বছরের পুরনো নিরাপত্তাকর্মী। তখন তিনি ফের কার্তুজ ভরছেন বন্দুকে। যাঁকে সবাই মিলে জাপটে ধরতে পালানোর চেষ্টাও করলেন না। উল্টে ঠান্ডা গলায় বললেন, “চার তলায় আর এক জনের লাশ আছে।” সেখান থেকে মিলল আর এক নিরাপত্তারক্ষীর দেহ।
পুলিশের দাবি, জেরায় ৫৭ বছরের সুনীল সরকার জানান, দীর্ঘ দিন ধরেই নানা ‘টিটকিরি’ সইতে হচ্ছিল তাঁকে। সহ্যের সীমা পেরোনোয় এ ভাবে বেরিয়ে এসেছে জমে থাকা রাগ। ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষও জেনেছেন, বহু বছর ধরে দুর্ব্যবহার সহ্য করে ভিতরে ভিতরে গুম মেরে ছিলেন প্রাক্তন সেনানী ওই প্রবীণ নিরাপত্তাকর্মী।
শুক্রবার দুপুরে রমেশ মিত্র রোডে স্টেট ব্যাঙ্কের ভবানীপুর শাখায় ক্যাশিয়ার মানব বসু (৫১) এবং আর এক নিরাপত্তারক্ষী রাধাকৃষ্ণ মণ্ডলকে (৫৭) গুলি করেন সুনীলবাবু। তাঁরা দু’জনেই মারা যান। প্রাথমিক তদন্তে এমনটাই জানা গিয়েছে বলে পুলিশের দাবি। এসবিআই কর্তৃপক্ষেরও বক্তব্য, খোঁজ নিয়ে তাঁরাও একই কথা জেনেছেন। দু’টি খুনের পরেও কেন সুনীলবাবু ফের বন্দুকে কার্তুজ ভরছিলেন, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
পুলিশের দাবি, জেরায় সুনীলবাবু বলেন, “অফিসে নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে আমিই সব চেয়ে সিনিয়র। অথচ, কেউ পাত্তা দিত না। উল্টে টিটকিরি দিত। অশ্লীল রসিকতা করত, এমনকী আমার পরিবার নিয়েও। আমিই ডিউটি ভাগ করতাম। কেউ মানত না। রাধাকৃষ্ণ তো ইচ্ছেমতো ডিউটি করত।” ক্যাশিয়ারকে মারলেন কেন? পুলিশের দাবি, উত্তরে সুনীলবাবু বলেন, “ও-ই (মানব বসু) ছিল নাটের গুরু। সবাইকে আমার বিরুদ্ধে উস্কানি দিত। আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বহু অনেক বলেছি। খালি প্রতিশ্রুতি দিয়েই তাঁরা খালাস।” |
এমনকী, ছুটি না-নিলেও তাঁর নামে ক্যাজুয়াল লিভের দরখাস্তও জমা পড়ে যেত বলে সুনীলবাবু পুলিশকে জানিয়েছেন।
এই জোড়া খুনের পিছনে অন্য কারণ আছে কি না, লালবাজারের গোয়েন্দারা সেটাও খতিয়ে দেখছেন। দেখা হচ্ছে একতলায় ব্যাঙ্কের সিসিটিভি-র ফুটেজও। ঠান্ডা মাথায় এ ভাবে পরপর খুনের কথা জেনে বিস্মিত তদন্তকারীরাও। তাঁদের বক্তব্য, চারতলায় রাধাকৃষ্ণের বুকে দু’টি গুলি করে দোনলা বন্দুক থেকে খালি কার্তুজ কোমরের থলিতে রাখেন সুনীলবাবু। দু’টি তাজা কার্তুজ বন্দুকে ভরে নামেন একতলায়। পুরোদমে চলা ব্যাঙ্কে সোজা গিয়ে দু’টি গুলি চালিয়ে দেন ক্যাশিয়ার মানববাবুর মাথায়। মানববাবু শেষ মুহূর্তে বাঁ হাতে আড়াল করেছিলেন। তাঁর আঙুল কেটে মেঝেতে পড়ে। সেটিরও ময়না-তদন্ত হচ্ছে। পুলিশ পৌঁছলে ঠান্ডা মাথায় সুনীলবাবু জানান, চারটি গুলি খরচ করেছেন, আরও ছ’টি কার্তুজ আছে।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “ক্যাশিয়ারকে খুনের পরে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছবি সরকার ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন, কী ঘটে গিয়েছে। সুনীল নিজেই জানান, চারতলায় এর আগে আর এক জনকে গুলি করেছেন। মোট চারটি গুলি খরচ হয়েছে।” সুনীল সরকারের বিরুদ্ধে খুনের এবং অস্ত্র আইনে মামলা রুজু করেছে পুলিশ। আজ, শনিবার তাঁকে আলিপুর আদালতে তোলা হবে।
পুলিশ জানায়, সম্ভবত সওয়া ১২টা নাগাদ রাধাকৃষ্ণকে দু’টি গুলি করেন সুনীলবাবু। চারতলায় ব্যাঙ্কের ক্যান্টিন ও বিশ্রামের ঘর। গ্রাহক ও কর্মীরা ভেবেছিলেন, বাজি বা টায়ার ফেটেছে। একই ভুল হয় ব্যাঙ্কের আশপাশে থাকা লোকজনেরও। মিনিট তিন-চার পরে ফের আওয়াজ আসে ব্যাঙ্কের একতলা থেকে। হতচকিত পথচারীরা দেখেন, ব্যাঙ্কের সদর দরজা ঠেলে ‘গুলি-গুলি’ বলে চিৎকার করতে করতে বেরোচ্ছেন কয়েক জন। ২০ বছর আগে এই ব্যাঙ্কেই ডাকাতি হয়েছিল। পাড়ার বয়স্করা প্রথমে ভেবেছিলেন, তেমনই কিছু ঘটেছে।
ব্যাঙ্কে ঢুকে সব দেখার পরে ব্যাঙ্ককর্মী ও এলাকাবাসী এতই বিহ্বল ছিলেন যে, পুলিশে জানানোর কথাও মাথায় আসেনি। পৌনে একটা নাগাদ পুর-চেয়ারম্যান ও স্থানীয় কাউন্সিলর সচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুর থানার ওসি-কে ফোন করেন। সচ্চিদানন্দবাবুর কথায়, “এত বড় ঘটনার পরেও সুনীল অদ্ভুত রকম ঠান্ডা ছিলেন। বরং, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বেশি উত্তেজিত হয়ে অনেক ভুল তথ্য দিচ্ছিলেন। সেগুলো ঠান্ডা মাথায় সংশোধন করছিলেন সুনীলই।” পুলিশ জানায়, এসবিআইয়ের সমস্ত রক্ষীই তাদের নিজস্ব। সকলেই প্রাক্তন সেনা। পুলিশ জানায়, সুনীল ও রাধাকৃষ্ণবাবু দু’জনেই ১৮ বছর ধরে ওই শাখায়। ভদ্র-শান্ত বলেই পরিচিত। তাঁর এই কাজ প্রত্যক্ষদর্শীদেরও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। |