এক হাতে এক মহিলার কাটা মুন্ডু। অন্য হাতে রক্তমাখা তলোয়ার। হনহন করে মহানগরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক যুবক। পিছনে কয়েকশো জনতা। বাচ্চা-বুড়ো-মহিলা-জোয়ান কে নেই সেই ভিড়ে!
শুক্রবার দিনদুপুরে এই বীভৎস দৃশ্যটার মুখোমুখি পড়ে গেল শহর।
বেলা তখন পৌনে এগারোটা। নাদিয়াল থানা এলাকার বাগদি পাড়া রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় কথা বলছিল এক যুবক আর এক মহিলা। অন্য আর এক মহিলা ওই দু’জনকে প্রাণপণ কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎই যুবক পোশাকের মধ্যে থেকে একটা তলোয়ার বার করে মহিলার গলায় বসিয়ে দিল কোপ। ধড় থেকে আলাদা হয়ে মাথাটা ছিটকে পড়ল রাস্তায়। পরিত্রাহি চেঁচিয়ে উঠলেন অন্য মহিলা, তলোয়ারের ঘায়ে জখম তিনিও। লোক জমতে শুরু করল। কিন্তু খোলা তলোয়ারের সামনে এগোবে কে? যুবক তখন চিৎকার করে বলছে, ‘‘এটা আমাদের পারিবারিক বিষয়। কেউ এগোলে গর্দান নামিয়ে দেব।’’
তুঁত-রঙা সালোয়ার-কামিজ পরা ধড় রাস্তাতেই পড়ে রইল। ডান হাতে মুন্ডুটা ঝুলিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করল সৌম্যদর্শন যুবকটি। বাড়ির অমতে বা ভিন্ গোত্রে বিয়ে করার ‘অপরাধ’ নয়। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পরিবারের সম্মানহানি করার দায়ে নিজের বোনকে এই ভাবে শাস্তি দিল দাদা। বোনের বয়স ২৪, নাম নিলোফার বেগম। দাদার নাম মেহতাব আলম (২৮)।
সাত ঘরা রোড, আব্দুল খবির রোড ধরে প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে তবে নাদিয়াল থানা। হাঁটতে হাঁটতে এক বার রাস্তায় পড়ে যায় মুন্ডু। আবার তুলে নিয়ে বোনের মাথার কোঁকড়া চুল আঙুলে পেঁচিয়ে নেয় দাদা। কয়েকশো জনতার মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে যায় সেই মুহূর্ত। থানার দরজার সামনে একটা পাতাবাহারের টব। তার পাশে মুন্ডুটা নামিয়ে রাখে সে। |
আয়ুব নগর, ওয়ারিশ নগর, বাগদি পাড়ার কয়েকশো লোক তখন থানার সামনে হাজির। ভিড়ের মধ্যেই যুবক পুলিশকে জানায়, মুন্ডুটা তার বোনের। সে-ই বোনকে খুন করেছে। এখন আত্মসমর্পণ করতে চায়। পুলিশের হাতে রক্তাক্ত তলোয়ারটাও তুলে দেয় সে। তার পর পর ক্লান্ত গলায় বলে ওঠে, “একটু জল দেবেন? বড় তেষ্টা পেয়েছে।” মেহতাবের হাতে জলের বোতল এগিয়ে দেয় পুলিশ। আর এক জন ত্রস্ত পায়ে মুন্ডুটা ভিতরে এনে একটা কাপড় ঢেকে দেয়।
মেহতাবের বাড়ি নাদিয়াল থানারই আব্দুল খবির রোডে। পেশায় দর্জি। ছ’ভাই, পাঁচ বোন। বোনেদের মধ্যে নিলোফার চতুর্থ, ভায়েদের মধ্যে পঞ্চম মেহতাব। বছর আষ্টেক আগে বন্দর এলাকার পাঁচুড়ের বাসিন্দা আকবর আলির সঙ্গে নিলোফারের বিয়ে হয়েছিল। ৬ এবং ৪ বছরের দু’টি ছেলেমেয়েও রয়েছে। পুলিশকে মেহতাবই জানায়, বেশ কয়েক মাস ধরে নিলোফার ও আকবরের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল। গত ২৮ নভেম্বর নিলোফার মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছিলেন। ২৯ নভেম্বর থেকে নিলোফারের খোঁজ মিলছিল না। থানায় নিখোঁজ ডায়েরিও করা হয়েছিল। মেহতাব পুলিশকে বলেছে, ৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সে জানতে পারে, তার বোন ফিরোজ আলি নামে এক যুবকের সঙ্গে আয়ুবনগরে রয়েছে। ফিরোজের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকেই নিলোফারের ঘনিষ্ঠতা ছিল।
ফিরোজ এমব্রয়ডারির কাজ করে। অবসর সময়ে রিকশা চালায়।
মেহতাব জেরায় জানায়, এ দিন সকালে সে আয়ুবনগরে যায়। সেখানে গিয়ে ফিরোজের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। বাড়িতে ছিলেন নিলোফার এবং ফিরোজের বউদি শাবানা বিয়াস সাব্বু। নিলোফার কেন ফিরোজের সঙ্গে পালিয়ে এসেছে, তার কৈফিয়ত চায় মেহতাব। শাবানা থামাতে গেলে মেহতাব তলোয়ারের কোপ বসায় তাঁর হাতে। তার পরে নিলোফারের চুল ধরে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। তলোয়ার হাতে এগোতে থাকে বাগদি পাড়া রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে।
মেহতাবের দাবি, সে নিলোফারকে বলেছিল, স্বামীর সঙ্গে থাকতে না চাইলে স্বামীকে তালাক দিয়ে দিতে। কিন্তু নিলোফার রাজি হননি। মেহতাব বোনকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়েও যেতে চেয়েছিল। নিলোফার তাতেও রাজি হননি বলে দাবি। যদিও মেহতাবই আবার বলেছে যে, আগামী ১৮ ডিসেম্বর দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা হবে বলে ঠিক হয়েছিল। তার আগে সে কেন এমন করল? বোনকে ফিরিয়ে আনাই লক্ষ্য হলে তলোয়ার নিয়ে গিয়েছিল কেন সে? উত্তর নেই। কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (বন্দর) মেহবুব রহমান বলেন, “দুই ছেলেমেয়ে ও স্বামীকে ফেলে বোনের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা মানতে পারেনি মেহতাব।” মেহতাবের বক্তব্য, এতে পরিবারের সম্মান নষ্ট হচ্ছিল। নিলোফারের বন্ধু ফিরোজের খোঁজ মেলেনি। মেহতাবদের বাড়িতে গিয়েও পাওয়া যায়নি কাউকে।
বাগদি পাড়ার রিকশা স্ট্যান্ডে থিকথিকে ভিড়। জনতাকে সরিয়ে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বাদে ঘটনাস্থল থেকে দেহ গার্ডেনরিচ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারল পুলিশ। আবারও জিজ্ঞেস করা হল, বোনকে এই ভাবে খুন করলে কেন? নির্লিপ্ত ভাবে মেহতাব বলে, ‘‘অ্যায়সে হী। জো কিয়া জান-বুঝকে কিয়া।” |