|
|
|
|
বিতর্ক... |
দুর্নীতির জন্য ভোট কমে না |
পক্ষে |
মানুষ ও নিয়ে মাথা ঘামায় না |
• দুর্নীতির জন্য ভোট কমা তো দূরের কথা, দুর্নীতিকে ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে আমাদের দেশে ভোট আরও বাড়বে। রিগিং, বুথ জ্যাম, পরিকল্পিত সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি, ভোটারদের হুমকি বা উপঢৌকন ইত্যাদি নানা ভাবে ভোট ম্যানেজ করাকে সুধী জনগণ যদি দুর্নীতি আখ্যা দেন, তা হলে বলতেই হবে ‘দুর্নীতির জয় হোক’। আর, বক্তিগত দুর্নীতির কাদা মেখে তা সে আর্থিক কলেঙ্কারিই হোক, যৌন কালিমাই হোক বা খুন-ডাকাতির মতো অপরাধই হোক কত প্রার্থীই তো ড্যাং ড্যাং করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাচ্ছে!
তবে হ্যাঁ, তার জন্য একটু ভাল সাজতে হয়ছে বইকী। আন্ডারপ্যান্টে যতই দুর্নীতির নোংরা লেগে থাক, মুখে জনদরদি জনশ্রুতির ফেস পাউডার আর গায়ে গরিবের বন্ধু রবিন হুডের আলখাল্লা পরে থাকলেই হল।
দুর্নীতিকে ফেয়ারনেস ক্রিম মাখানোর একটা ট্র্যাডিশন তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আড়াল থেকে বাণ মেরে রামের বালী বধ, কোমরের নীচে অন্যায় ভাবে গদা মেরে ভীমের দুর্যোধন বধ, রথের চাকা মাটিতে বসে যাওয়ার সুযোগে অর্জুনের কর্ণ বধ বা বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতা এ সবই আক্ষরিক অর্থে দুর্নীতি হওয়া সত্ত্বেও জনপ্রিয়তার ভোটে রাম ভীম বা অর্জুন অনেক এগিয়ে। তার সহজ কারণ হল, এ সব কীর্তির গায়ে ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ জাতীয় তকমা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো দু’চার জন ভিন্নমতাবলম্বী বিরোধী পক্ষ যতই রাবণ বা কর্ণকে মহাকাব্যের শ্রেষ্ঠ চরিত্র বলে স্লোগান দিন বা যতই ইন্দ্রজিৎকে দিয়ে বিভীষণকে বক্তৃতার খোঁচা খাওয়ান, জনসাধারণের গ্রহণযোগ্যতার ভোটে তাদের জামানত জব্দ হয়ে গেছে।
তাই বলি কী, ‘অভিযোগ ভিত্তিহীন’, ‘সংবাদপত্রের প্ররোচনা’, ‘বিরোধীদের অপপ্রচার’, ‘সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র’ প্রভৃতি নানা রকম হাইব্রিড শাক দিয়ে মাছ ঢেকে দুর্নীতিকে একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলে ভোট কমার কোনও প্রশ্নই উঠবে না।
চঞ্চল পাল। কলকাতা-৪
|
• • • ২ • • • |
• প্রায়শই সংবাদপত্রে দেখি, জেলের ভিতর থেকেই বাহুবলী, দুর্নীতির শিরোমণিরা দিব্যি ভোটের বাক্সে কিস্তিমাত করছেন।
ভোটাররা এখন প্রার্থী দেখে ভোট দেয় না। দেয় পার্টি দেখে। ভোটারদের অধিকাংশই যেন আজ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। অথবা হয়তো ভোটাররা তখন চোখে কালো কাপড় বাঁধা গান্ধারী। নিজের পার্টির গুণধরদের কোনও দোষই দেখেন না তাঁরা। উল্টে বলেন, এ সবই ‘নিন্দুকের অপপ্রচার’। তা না-হলে যে দেশে মশা, মাছির মতো দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিকের জন্ম হয়, সেখানে সংসদ আলো করে এঁদের অনেকেই বহাল তবিয়তে বসে থাকেন কীভাবে? এ ভাবেই তো গণতন্ত্র আসলে একটা জঘন্যতন্ত্রে পরিণত হয়।
অরূপরতন আইচ। কোন্নগর, হুগলি
|
|
• • • ৩ • • • |
• হায় ভগবান! দুর্নীতির জন্য ভোট কমবে কেন? দুর্নীতি করার বৈধ (!) অধিকার পেলেই তো ভোট বাড়ে। আর পার্টির নেতাকে জেতানোর জন্য তার অনুগামীরা বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট প্রভৃতির মাধ্যমে সেই দুর্নীতিরই আশ্রয় নেয়।
সুনীতি-দুর্নীতির কূটতর্কে প্রভাবিত হয় গোটাকতক শিক্ষিত তাত্ত্বিক মানুষ। কিন্তু এর বাইরে পড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ গ্রামবাংলার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ। বফর্স, পশুখাদ্য, পরমাণু চুক্তি, এফডিআই বা কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তারা আদার ব্যাপারি, জাহাজের খোঁজ রেখে তাদের লাভ কী?
গ্রামবাংলার এই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের ‘রাজনৈতিক আইডেনটিটি’ কী ভাবে তৈরি হয় জানেন? জ্ঞাতিবিবাদ, ব্যক্তিস্বার্থের সংঘাত, পঞ্চায়েতের অনৈতিক দাক্ষিণ্য, দু’খানা ত্রিপল, দু-কেজি গম ইত্যাদি খুবই সংকীর্ণ কারণে এদের রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটে। সি পি এম-এর মকবুল শেখকে টাইট করতে হলে তৃণমূল করা দরকার কিংবা কংগ্রেসের গুরুপদবাবু আমার পাকা ধানে মই দিয়েছে, আর এস পি-কে দিয়ে ওকে ভিটেছাড়া করাব। ‘গণতন্ত্র’ নামক ভদ্রলোকটি বেঁচে আছে শরীরের শিরা-ধমনীতে ‘দুর্নীতির বদরক্ত’ নিয়ে। এই বদরক্তের জোগান যত বাড়বে, গণতন্ত্র ততই চাঙ্গা হবে আর ভোটও তত বাড়বে।
সাধন দাস। ভৈরবটোলা, লবণচোয়া, মুর্শিদাবাদ
|
• • • ৪ • • • |
• ভোটে জেতার সঙ্গে নীতি বা দুর্নীতির কোনও সম্পর্কই নেই। ভোটাররা যদি মনে করেন, আপনি পাইয়ে দিতে পারবেন, তা হলে আপনি ভোট পাবেন, না হলে নয়।
তরুণ কর। কলকাতা-১
|
|
বিপক্ষে |
শেষ পর্যন্ত প্রতিফল মেলেই |
• স্বাধীন ভারতবর্ষে এ কথা অন্তত দু’বার প্রমাণিত হয়েছে, বড় মাপের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের ভোট শুধু যে কমে তা নয়, ভীষণ ভাবে কমে। প্রথম দৃষ্টান্ত, ইমার্জেন্সি পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গাঁধী ও কংগ্রেসের ভরাডুবি। ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে ইন্দিরা গাঁধী দুর্নীতির চেয়ে বহু গুণ মারাত্মক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন নিজের প্রধানমন্ত্রিত্ব বাঁচাবার জন্য। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে দেশব্যাপী গণতন্ত্রের অধিকার হরণের প্রচেষ্টার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন ভোটের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত, বফর্স কেলেঙ্কারি। রাজীব গাঁধীর নেতৃত্বে প্রথম বার লোকসভা নির্বাচনে তিনি নিজে ও তাঁর দল রেকর্ডসংখ্যক ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু বফর্স কামান ক্রয় সংক্রান্ত আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ এমন দেশব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল যে ভোটাররা একযোগে কংগ্রেসকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
আমাদের দেশের কুড়ি কোটি মানুষের অধিকাংশ গরিব ঠিকই, কিন্তু প্রতি বারই নির্বাচনের ফল বলে দেয়, তাঁরা নির্বোধ নন। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যত আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এমনটি আগে কখনও হয়নি। দুর্নীতির কাদায় হাবুডুবু খাওয়া নেতারা যদি মনে করে থাকেন, সাধারণ মানুষ তাঁদের কুকীর্তি নিয়ে মাথা ঘামান না, তবে তাঁরা মূখের্র্র স্বর্গে বাস করছেন। যথা সময়ে দেখা যাবে, ভোটের পরীক্ষায় তাঁদের পাশ মার্ক জোটেনি।
সঞ্জিত ঘটক। নরেন্দ্রপুর
|
|
• • • ২ • • • |
• ভারত যেমন বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ, তেমনই একটি দুর্নীতিপরায়ণ দেশও এই ভারত। তবুও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ গণতন্ত্রের পক্ষে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, ভোটাদাতাদের ভোটে বার বার পরাভূত হয়েছেন দুর্নীতিগ্রস্ত ভোটপ্রার্থীরা বা কোনও না কোনও সরকার। এক কালের বফর্স কেলেঙ্কারি, পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি, ঘুষকাণ্ড প্রভৃতির ন্যায় বহুল প্রচারিত কেলেঙ্কারি বা দুর্নীতির সঙ্গে যে সব রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সরকারের নাম জড়িয়ে গিয়েছিল জনগণ কিন্তু তাদের ক্ষমা করেননি। ভোটের মাধ্যমে তাঁদের বা তাঁদের সরকারকে করেছেন পরাজিত। এ রাজ্যের ৩৪ বছরের দুর্নীতিবাজ বামফ্রন্ট তথা সি পি এম-এর সরকারকে ক্ষমতা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন বাংলার জনগণ কিন্তু ভোটাধিকার প্রয়োগ করেই। টু জি স্পেকট্রাম, কমনওয়েলথ গেমস, আদর্শ আবাসন, কয়লা ব্লক বণ্টন প্রভৃতি দুর্নীতির ফলে কংগ্রেস পরিচালিত ইউ পি এ সরকারের জনপ্রিয়তা বহুলাংশে পেয়েছে হ্রাস। তার প্রমাণ মিলেছে, সাম্প্রতিক কালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে ইউ পি এ প্রার্থীরা হয় পরাজিত হয়েছেন, নয়তো কম ভোটে জিতেছেন। অর্থাৎ, ভোট কমেছে। আর এর জন্য দায়ী দুর্নীতি নিঃসন্দেহে। মনে রাখা উচিত, দোর্দণ্ডপ্রতাপ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পরাজয় নিশ্চিত করেছিল কুখ্যাত ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারি।
ধীরেন দেবনাথ। কল্যাণী, নদিয়া
|
• • • ৩ • • • |
• দুর্নীতির জন্য যে ভোট কমে তার প্রমাণ কেন্দ্র এবং রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল বেশ ভালই টের পেয়েছে। নাসবন্দি প্রকল্প, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, গরিবি হঠাও-এর নাম করে বুলডোজার চালিয়ে গৃহহীন করা ইত্যাদি এবং আমাদের রাজ্যে নকশাল আন্দোলন দমনের নাম করে অবলীলায় তাদের হত্যা করা ইত্যাদি নানা দুর্নীতির জন্য ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস কম ভোট পেয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়। অন্য দিকে, নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানো, সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক চাষিদের জমি জোর করে অধিগ্রহণ থেকে তাপসী মালিক হত্যাকাণ্ড, মেদিনীপুরের কঙ্কালকাণ্ড ইত্যাদি নানাবিধ দুর্নীতির কারণে দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট সরকার ১৯১১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয় বিপুল পরিমাণ কম ভোট পাওয়ার জন্য। উন্নত মানের রিগিং পদ্ধতিতে অনেক সময় ভোট পেয়েও দুর্নীতিযুক্ত সরকার ক্ষমতা ধরে রেখেছে, এমন অভিযোগ শোনা গেলেও একটা সময় কিন্তু দুর্নীতির জন্য ক্ষমতাহীন হতেই হয়।
মণিদীপা গুপ্ত। কলকাতা-১৫৭
|
• • • ৪ • • • |
• দুর্নীতির জন্য ভোট কমে না, কথাটার মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি, গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের প্রতি এক ধরনের অশ্রদ্ধা লুকিয়ে আছে বলে মনে হয়। কথাটা ঠিক নয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, মানুষ দুর্নীতিগ্রস্তদের দিকে ঠিকই নজর রাখেন এবং এক সময় না এক সময় তাঁদের শাস্তি দেন। এটা ঠিকই যে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা বা নেত্রীরা অনেক সময় জনসমর্থন পেয়ে থাকেন। কিন্তু তার একটা বড় কারণ হল, তাঁদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের সৎ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকেন না। অর্থাৎ ভোটারদের সামনে যে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে, সেটাই যথার্থ বিকল্প নির্বাচনের সুযোগ নয়। আর, শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার কল ভোটে নড়ে। লালুপ্রসাদ তা জানেন।
ললিতা মিত্র। বর্ধমান |
|
|
|
|
|
|