তিনি উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি পার্কে এক রকম নিজে নিজেই খেলা শেখা এক দশকেরও আগে প্রয়াত বাঙালি ওপেনিং ব্যাটসম্যান।
ইনি কিংবদন্তি মুম্বইকর। যাঁকে হয়তো যথার্থ ব্যাখ্যা করা যায় ‘মিস্টার ইন্ডিয়ান ক্রিকেট’ বলে।
সেই পঙ্কজলাল রায় এবং সচিন রমেশ তেন্ডুলকর সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনের ভরদুপুরে মধ্য কলকাতার এক হোটেলে নানা পেশার কৃতীদের উপস্থিতিতে কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলেন।
আধুনিক বঙ্গ ক্রিকেটের পিতামহ পঙ্কজ উত্থিত হলেন বিস্মৃতির অতল থেকে সোনালি স্মৃতিচারণের শৃঙ্গে। যার সূত্র ধরিয়ে দিলেন সচিন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি থেকে জগমোহন ডালমিয়া। আবার সেই সচিনই টের পেলেন, সাম্প্রতিক রানের খরা কাটিয়ে ফের তাঁর একমেবাদ্বিতীয়ম ব্যাটিং জাদু দেখতে কতটা মুখিয়ে কলকাতা। নইলে সৌরভ পর্যন্ত তাঁর ‘ছোটবাবু’র দিকে তাকিয়ে বলে ফেলেন “সচিন আশা করি এ সপ্তাহেই ইডেনে টেস্ট সেঞ্চুরি করবে। ওর জন্য শুভেচ্ছা থাকল।” |
তবু এই দুপুরের মধ্যমণি সচিন নন। গৌতম ভট্টাচার্যের লেখা এবং প্রণব রায় সম্পাদিত দ্বিভাষিক (বাংলা এবং ইংরেজি) বই ‘পঙ্কজ’-এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশ উপলক্ষে উপস্থিত ‘সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি’র মালিকের দীর্ঘদিনের ওপেনিং পার্টনার সৌরভ নন। এমনকী এক ফ্রেমে দাঁড়ানো ধোনির টিম ইন্ডিয়ার বাকি সদস্যরাও নন। মধ্যমণি হলেন সাদা-কালো ছবিতে বিনা হেলমেটে চশমা চোখে বাইশ গজে দাঁড়ানো এক বাঙালি।
পঙ্কজ রায়।
পঞ্চাশের দশকে ৪৩ টেস্টে ভারতের ইনিংস ওপেন করে ২৪৪২ রান করা পঙ্কজ রায়। যাঁর শেষ টেস্ট খেলার ৩৬ বছর পর ক্রিকেটের ধাত্রীগৃহ লর্ডসে টেস্ট আবির্ভাবেই সেঞ্চুরি করেন বেহালার এক বাঁ-হাতি। কেউ কেউ বলেন, বেহালাবাসীর দাপটে ৮ নম্বর অভয় মিত্র স্ট্রিটের ছোটখাটো চেহারাটি যেন বিস্মৃত মহানায়ক। অথচ সেই বাঙালিরই টেস্টে প্রথম উইকেটে ৪১৩ রানের বিশ্বরেকর্ড (বিনু মাঁকড়ের সঙ্গে পার্টনারশিপে) অর্ধশতাব্দীরও বেশি অক্ষত ছিল।
কী আশ্চর্য! সৌরভই গোটা টিম ইন্ডিয়ার সামনে পঙ্কজের ৩২ টেস্ট গড়ের সঙ্গে আরও ১০ যোগ করে সেটাকে ৪২ বানিয়ে দিলেন। বলে দিলেন, “হেলমেট ছাড়া আর হেলমেট পরে ব্যাট করা দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা যুগ। পঙ্কজদা সারা জীবন হেলমেট না পরে টেস্টে ব্যাটিং ওপেন করেছেন। তার জন্য সব সময় আরও ১০ রান ওঁর প্রত্যেকটা ইনিংসের সঙ্গে যোগ করতে হবে। তার ওপর চশমা পরে খেলতেন। আমি নিজে চশমা পরি বলে জানি, সেটা কতটা সমস্যার ব্যাপার। আমি না হয় আধুনিক যুগের সুযোগ নিয়ে সারা জীবন কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে খেলেছি। পঙ্কজদা সেই সুযোগও পাননি।” মজার কথা, ইডেনে কিন্তু সৌরভের চেয়ে পঙ্কজের টেস্ট পারফরম্যান্স ভাল। অগ্রজের ইডেনে ৬ টেস্টে ৩৫৮ রান। গড় ৩৫.৮০। অনুজের সেখানে ৮ টেস্টে ৪৪০ রান। গড় ৩১.৪২। সেঞ্চুরি দু’জনেরই একটি করে। |
সেই অনুজ টিম ইন্ডিয়ার রূপকার এবং তাঁর বিশ্বজয়ী উত্তরসূরিকে এ দিন বিরল ফ্রেমে বন্দি করে দিলেন বিস্মৃত মহানায়কই। এ দিন পাশাপাশি বসেছিলেন সৌরভ এবং ধোনি। মিলের চেয়ে যাঁদের মধ্যে গরমিলই বেশি। কিন্তু মিলিয়ে দিলেন পঙ্কজ। সেই আবহের সঙ্গে তাল রেখেই যেন ধোনি বললেন, “পঙ্কজ রায়কে ক্রিকেটারের চেয়েও বেশি করে জানতাম প্রণবের (উচ্চারণ করলেন অবশ্য ‘প্রণয়’) বাবা হিসেবে।” এর সঙ্গে ভারত অধিনায়ক যেটা যোগ করলেন, সেটাই বোধ হয় বিস্মৃত পঙ্কজকে স্মরণের সরণিতে প্রতিষ্ঠিত করার অন্যতম উদাহরণ। বললেন, “প্রত্যেক ছেলেরই ইচ্ছে থাকে তার ড্যাডিকে জীবনের কোনও না কোনও সময় একটা সেরা উপহার দেওয়ার। ফুচাদা ওর বাবার প্রথম জীবনী বার করে সেটাই করেছে।”
এবং সচিন। প্র্যাক্টিসে নামার আগে ঘণ্টাখানেক তো এখানে কাটিয়ে গেলেনই। প্র্যাক্টিস থেকে ফেরার পরেও তাঁর মন জুড়ে পিতামহ পঙ্কজ। দু’দিন বাদেই মহাগুরুত্বপূর্ণ টেস্ট। তবু সন্ধেতেও সচিন অনুষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তাকে নিজে ফোন করে বলেন, “আমাদের দেশের এ রকম এক জন যোগ্য ক্রিকেটার, যিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি, তাঁকে এ ভাবে শ্রদ্ধা জানাতে দেখে ভীষণ ভাল লাগল।” বহুপ্রতীক্ষিত যে শ্রদ্ধার্ঘ্যের মূল মন্ত্র হয়তো বইটির প্রচ্ছদেই খোদিত‘বেঙ্গল’স ফরগটেন ক্রিকেট লেজেন্ড’। বঙ্গ ক্রিকেটের বিস্মৃত মহানায়ক। কিংবা শুধু ক্রিকেট নয়। ক্রিকেটের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়ে এক চিরন্তন বাঙালি রূপকথায় পঙ্কজের উত্তরণ এ দিন দেখল তাঁর শহর। |