কোনও দায়িত্বপূর্ণ পদে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে যে দায়িত্বজ্ঞান লইয়া বিচরণ করিতে হয়, এই সাধারণ বুদ্ধির কথাটি বিস্মৃত হওয়াকে দস্তুর করিয়া ফেলিয়াছে বর্তমান রাজ্য প্রশাসন। একের পর এক ঘটনায় তাহার উপর্যুপরি প্রমাণ। অথচ প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনাই অবাঞ্ছিত। যাহা না ঘটিবারই কথা ছিল, এবং না ঘটিলেই সকলের পক্ষে উত্তম হইত, সেই রকম অবাঞ্ছিত। সম্পূর্ণ অনাবশ্যক কথা বলিয়া, অকারণ আক্রমণ করিয়া, অবাঞ্ছিত কুনাট্য নির্মাণ করিয়া প্রত্যহ এই সাধারণ বুদ্ধির সামগ্রিক নাশের প্রদর্শনী চলিতেছে পশ্চিমবঙ্গে। কৃষিবিভাগের প্রতিমন্ত্রী পদে আসীন হইয়া সপ্তাহ না পুরাইতেই বেচারাম মান্না যে সুরে দেশের বিচারবিভাগকে আক্রমণ করিলেন, তাহা কেবল রাজ্যবাসী নহে, সমগ্র দেশবাসীকেই সচকিত ও বিস্মিত করিতেছে। সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে এত নির্দ্বিধ এবং প্রত্যক্ষ আক্রমণ কোনও মন্ত্রীর মুখে উচ্চারিত হইতে শুনা একটি বিরল অভিজ্ঞতাই বটে। ভারতীয় সংবিধানের তিন প্রধান স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম স্তম্ভ বিচারবিভাগের বিরুদ্ধে এমন সুর প্রয়োগ কিংবা এমন বক্তব্য প্রকাশ শাস্তিযোগ্য যে শাস্তির নাম আদালতের অবমাননা। সেই শাস্তি মন্ত্রিবরের উপর বর্ষিত হইবে কি না, সময়ই তাহা বলিবে, কিন্তু তাহারও আগে জনপ্রতিনিধির মুখে এ হেন চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গবাসীকে যে গভীর লজ্জার ভাগী হইতে হইল, তাহার ধিক্কার বর্ষিত হইতেছে শ্রীযুক্ত মান্নার উপর।
ধিক্কার আরও গভীরতর এই জন্য যে, চলতি বৎসরেই, একই লজ্জা রাজ্যবাসী ভোগ করিতেছেন দ্বিতীয় বার! ইতিপূর্বে ১৪ অগস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং চিৎকৃত অভিযোগ তুলিয়াছিলেন একই মর্মে: বিচারবিভাগের একাংশ ‘ক্রীত’ বলিয়া অভিসন্ধিপরায়ণ রায় প্রদান করিয়া থাকেন। মুখ্যমন্ত্রী যখন জানিতে পারেন যে এক মানবাধিকার সংস্থা রাজ্য সরকারের নিকট ফেসবুক-খ্যাত অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিবার দাবি জানাইয়াছে এবং সেই সংস্থাটির প্রধান হইলেন সুপ্রিম কোর্টের এক প্রাক্তন বিচারপতি তখনই ধৈর্য ও সংযমের বাঁধ টপকাইয়া তিনি এই মন্তব্যে উপনীত হন। তবে, এই মন্তব্যের একটি পরোক্ষ উপলক্ষও ছিল। তাহা বর্তমান রাজ্য সরকারের বিপক্ষে কলিকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গুরের কৃষিজমি-সংক্রান্ত রায়। মুখ্যমন্ত্রী ইহাও বলেন যে প্রয়োজনে এই বক্তব্যের কারণে তিনি গ্রেফতার বরণ করিতেও রাজি। না, তাঁহাকে গ্রেফতার হইতে হয় নাই। পরিবর্তে তাঁহার পদচিহ্ন রাজ্য রাজনীতির পটভূমিতে গভীর ভাবে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছে, তাঁহার প্রভাব অনুগামী রাজনীতিকদের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করিতেছে। বেচারাম মান্না সেই প্রভাবধারারই যোগ্য প্রতিনিধি।
পরবর্তী কালে মুখ্যমন্ত্রী নিজের বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তি দিয়াছিলেন যে তিনি তো বিচারব্যবস্থার মূল্যবোধ-ভিত্তির কথাই বলিতে চাহিয়াছিলেন, বিচারবিভাগীয় সংস্কারের প্রয়োজন স্মরণ করাইতেছিলেন। ইহার উত্তরে একটি কথাই বলা যায়। তিনি কী বলিতে চাহিয়াছিলেন তিনিই জানেন, তবে যাহা শুনা গিয়াছিল তাহা এ জাতীয় কোনও গঠনমূলক সংস্কারকামী সুবাক্য নহে। সন্দেহ নাই, বেচারাম মান্নার বক্তব্যের সমর্থনও ক্রমে রচিত হইবে। তবে তাহা হইবে কঠিনতর কাজ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেহেতু কোনও বিশেষ প্রসঙ্গ উল্লেখ না করিয়াই মন্তব্যটি করিয়াছিলেন, তাঁহার ক্ষেত্রে ‘সংস্কার’ ইত্যাদি যুক্তির অবতারণা সম্ভব ছিল। বেচারাম মান্না কিন্তু সরাসরি সিঙ্গুরের উল্লেখ করিয়াছেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায় মনোমতো না হইলে মাঠে নামিয়া আইন নিজেরাই তৈরি করিয়া নিবেন ‘আশ্বাস’ দিয়াছেন। ‘সংস্কার’ প্রস্তাব বা ‘পরামর্শ’, কোনও আখ্যাতেই তাঁহার মর্মার্থের পুনর্নির্মাণ অসম্ভব। সুতরাং এখন সম্মানজনক পশ্চাদপসরণের পথ একটিই। ভুল স্বীকার। গণতন্ত্রের মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক নীতি লঙ্ঘনের এই দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত একমাত্র এই ভাবেই খানিকটা লঘু হইতে পারে। ভুল স্বীকারে কোনও লজ্জা নাই, বরং গৌরব আছে। অনৈতিকতার সপক্ষে হাস্যকর সমর্থনবাক্য না আউড়াইয়া এক বার অন্তত সময় থাকিতে থাকিতে মন্ত্রিবর কিংবা তাঁহার ‘কর্ত্রীপক্ষ’ ভুল স্বীকারের বিষয়টি ভাবিয়া দেখিতে পারেন। |