ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেনে এক সময়ে প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল। এখন তা ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে ধরে রাখার কোনও চেষ্টা রেল কর্তৃপক্ষ করেননি। ১৯৯৫ সালের পরে ওই ট্রেনের ইঞ্জিনগুলিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। কাটোয়াতেও অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ৯৮ বছরের একটি স্টিম ইঞ্জিন। সেই ইতিহাস যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য সরব হয়েছেন কাটোয়ার রেলকর্মী থেকে সাধারণ বাসিন্দারা।
লন্ডন থেকে জয়পুর, অনেক জায়গাতেই সংরক্ষিত হচ্ছে ন্যারোগেজ লাইনের স্টিম ইঞ্জিন। হাওড়া স্টেশনের বাইরে রয়েছে এমন ইঞ্জিন। হাওড়া রেল মিউজিয়ামেও সংরক্ষিত রয়েছে ন্যারোগেজ লাইনের স্টিম ইঞ্জিন। অথচ কাটোয়ার ন্যারোগেজ লাইনের লোকোয় অসংরক্ষিত ভাবে পড়ে রয়েছে ছোট রেলের একটি ইঞ্জিন। সেই ইঞ্জিনটি (রেলের পরিভাষায় যার নাম একে ১৫) সংরক্ষণেরই দাবি তুলেছেন রেলকর্মীরা ও স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। সম্প্রতি রেলের একটি সভায় তিনি রেলের প্রতিমন্ত্রীর সামনে দাবি করেন, কাটোয়া ন্যারোগেজ লাইনের ইঞ্জিন হাওড়া-সহ বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। অথচ কাটোয়ায় একটি ইঞ্জিন অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সেটিকেও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। প্রস্তাবের জবাবে রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেন, “ওই ইঞ্জিন রেল মন্ত্রকের সম্পত্তি। সেটিকে সংরক্ষণ করা দরকার বলে আমিও মনে করি। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি।” |
রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৯৫ সালের এপ্রিল থেকে স্টিম ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। শুরু হয় ডিজেল ইঞ্জিনের ব্যবহার। ফলে এক সঙ্গে কাটোয়া-বর্ধমান ও কাটোয়া-আমোদপুর শাখায় ১৭টি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ওই ইঞ্জিনগুলির মধ্যে বিকে-১ আসানসোল স্টেশন, বিকে-২ দিল্লি, বিকে-৩ শিয়ালদহ এবং বিকে-৪ রাজস্তানের জয়পুরে রামবাগ প্যালেস হোটেলে ১৯৯৬ সালের মে মাস থেকে রয়েছে।
১৯৯৬ সালের নভেম্বরে একে-১৬ ইঞ্জিনটি কিনে নেয় ব্রিটেনের ব্রেকন মাউন্টেন রেলওয়ে কোম্পানি। সেটি এখন রয়েছে সারেতে। ওই বছর অক্টোবর থেকে হাওড়া স্টেশনের বাইরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে একে-৬ ইঞ্জিনটি। হাওড়া রেল মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে বিকে-১৩ ইঞ্জিনটি। ওই সব ইঞ্জিনগুলির মধ্যে দিল্লিতে থাকা বিকে-২ ইঞ্জিনটি শতাধিক বছরের পুরনো। ১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল বিকে-৬ ইঞ্জিনটি।
রেল দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কাটোয়ায় থাকা একে-১৫ ইঞ্জিনটি ইংল্যান্ডের স্ট্যাফোর্ডের ডব্লুজি বাগনাল কোম্পানি। ৯৮ বছরের পুরনো এই ইঞ্জিনটি কিনেছিল ম্যাকলিওড কোম্পানি। ১৯১৫ সালে বর্ধমান-কাটোয়া এবং ১৯১৭ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর কাটোয়া-আমোদপুর রেলপথটি তৈরি হয়। ওই দুই রেলপথের মালিকানা ছিল ম্যাকলিওড কোম্পানির হাতেই। এছাড়া ওই কোম্পানির হাতে ছিল বিডিআর ও কালীঘাট-ফলতা রেলপথটিও। ১৯৬৬ সালে কাটোয়ার ন্যারোগেজ দু’টি ভারতীয় রেলের হাতে চলে আসে। কাটোয়া স্টেশনে থাকা ইঞ্জিনটি ১৯৯৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেলপথে যাতায়াত করেছে।
একে-১৫ ইঞ্জিনটির ওজন প্রায় ২৮ টন, উচ্চতা তিন মিটারের উপরে আর চওড়ায় প্রায় আড়াই মিটার। বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ইঞ্জিনটি খোলা আকাশের নীচেই পড়েছিল। রেলকর্মীদের দাবি, বছর সাতেক আগেই ওই ইঞ্জিনটিকে রেল ইয়ার্ডের ভিতরে নিয়ে আসা হয়। তার পর থেকে প্রতি বছর সেটি রং করা থেকে পরিষ্কার করা, সব কিছুই করেন তাঁরা। কাটোয়ার রেলকর্মীদের অভিযোগ, ইঞ্জিনটির উপরে রেল কর্তৃপক্ষের কোনও নজর নেই। দু’-এক বার অন্য জায়গায়ও নিয়ে যেতে চেয়েছিল। তাঁদের কথায়, এই ধরনের ইঞ্জিন অন্য জায়গায় সংরক্ষিত হয়েছে। অথচ কাটোয়ায় এখনও সংরক্ষণ করা হয়নি। রেলকর্মীদের দাবি, কয়েক বছরের মধ্যেই ন্যারোগেজ লাইন কাটোয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। স্টিম ইঞ্জিন আর নেই। এই ইঞ্জিন-সহ একটি ছোট ট্রেন সংরক্ষণ করা হলে তা ইতিহাস হয়ে যাবে।
ইঞ্জিনটি কী ভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব, সে ব্যাপারে হাওড়া ডিভিশনের আধিকারিকদের চিন্তাভাবনা করতে বলেছেন রেলের প্রতিমন্ত্রী অধীরবাবু। |