বাবা জ্ঞান দিয়ো না
‘সৌরভের মতো সারাক্ষণ মিডিয়া হাইপে থাকলে পাগল হয়ে যেতাম’
বাঙালি পরিবারে জন্ম। কলকাতায় মামাবাড়ি। ছোটবেলায় দাদু-দিদার সঙ্গে কলকাতায় গরমের ছুটি কাটানো। সব মিলিয়ে বাঙালিয়ানার গন্ধ থাকলেও আদতে গ্লোবাল সিটিজেন। বছরের মধ্যে তিরিশ সপ্তাহ কাটান সিঙ্গাপুর থেকে যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন থেকে মালয়েশিয়ায়। সাহেবি ইংরেজির পাশাপাশি গড়গড় করে বলেন হিন্দি, পঞ্জাবি। গল্ফ কোর্সের সবুজ, মসৃণ দিগন্তে যাঁর আত্মপ্রকাশ সাড়া ফেলে দিয়েছে বাঙালির খেলা-পাগল দুনিয়ায়।
তাঁর, মানে অনির্বাণ লাহিড়ির সঙ্গে আড্ডায় উঠে এল নানান মজাদার তথ্য। বাংলা সিনেমা থেকে বাঙালি বান্ধবী, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে টাইগার উড্স।

টাইগার যখন টিচার
গল্ফের সঙ্গে যাঁর নামটা বহু কাল ধরে সমার্থক ছিল, সেই টাইগার উড্সের সিংহাসন আজ আর নেই। অনির্বাণের কাছে অবশ্য টাইগারের যৌন বিতর্কের চেয়ে অনেক বড় ক্যানভাসে দেখা দেয় তাঁর নিষ্ঠা, তাঁর অধ্যবসায়। টাইগারের কাছ থেকে শেখা তিনটে জিনিস? “ট্যুরের জন্য নিজেকে তৈরি করা। ফোকাস ঠিক রাখতে জানা। যাবতীয় বাধা টপকাতে শেখা।” স্বপ্ন দেখেন, কোনও দিন আপনাকে বলা হবে বাংলার টাইগার উড্স? “মারাত্মক চাপের ব্যাপার তো! তবে চাপটা আমি নিতে পারব। কিন্তু এ সব স্বপ্নে গা ভাসিয়ে দেব না। একবার মাথা ঘুরে গেলেই সব শেষ।”

গল্ফের সৌরভ
“ওরে বাবা! সৌরভ বিরাট মাপের স্পোর্টসম্যান। ওর কাছাকাছি পৌঁছতে এখনও অনেক দেরি আছে। ওর মতো আন্তর্জাতিক সাফল্য এখনও পাইনি।”

মিসেস লাহিড়ি
কেমন হবেন মিসেস লাহিড়ি? তাঁকে কি বাঙালি হতেই হবে? “ধুর, বাঙালি হতেই হবে এমন কোনও মানে নেই। হয়তো সে বাঙালি হবেও না। কিন্তু একটা জিনিস মাস্ট। আমার লাইফ-পার্টনারকে গল্ফ বুঝতে হবে। কারণ গল্ফই আমার জীবন।”

বাঙালিবাবু
ছ’ফুটের উপর লম্বা, ছিপছিপে তরুণ গল্ফ-ক্লাবস হাতে যতটা কঠিন, ক্লাবস সরিয়ে রাখলে ততটাই মিষ্টভাষী। পিজিটিআই টুর্নামেন্ট খেলতে শহরে পা দেওয়ার চব্বিশ ঘণ্টাও কাটেনি, মিডিয়ার সস্নেহ অত্যাচারে প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন অনির্বাণ। আর কলকাতার মিডিয়ার প্রশ্নগুলোও একমুখী। বাংলা বই পড়েন? বাংলা সিনেমা দেখেন? সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখেছেন? বাংলা ব্যান্ডের গান শোনেন? প্রশ্নের তির সামলাতে সামলাতে এক সেকেন্ডের জন্যও বিরক্ত শোনায় না তাঁর গলা। মিলিটারি পরিবারে বড় হয়েছেন বলেই হয়তো তাঁর সৌজন্যবোধ এত প্রখর। “জানতাম কলকাতার সাংবাদিকেরা আমাকে এই প্রশ্নগুলোই করবেন। আপনাদের হতাশ করে বলতেই হচ্ছে, বাংলা গান, সিনেমা বা বই কোনও কিছুর সঙ্গেই সে ভাবে পরিচয় হয়নি,” মিষ্টি হেসে বলেন অনির্বাণ। উচ্চারণে একটু অবাঙালি টান থাকলেও তিনি বাংলাটা বেশ ভালই বলেন। “চোদ্দো-পনেরো বছর বয়সে আমার বাবা যখন বিনাগুড়ি-তে পোস্টেড ছিলেন, তখন স্কুলে বাংলা শিখতে হয়েছিল। তখন ভাষাটা বেশ ভাল লিখতে-পড়তে পারতাম। এখনও আমার বলতে কোনও অসুবিধে হয় না। কিন্তু পড়তে গেলে দাঁত ভেঙে যায়! কিন্তু বাংলা পড়তে অসুবিধে হলেও বাঙালিয়ানাটা আমার মজ্জাগত।”
কলকাতার সেরা স্মৃতি
কলকাতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তাঁর সব চেয়ে সুখের স্মৃতি অবশ্য ছোটবেলার নয়, গত বছরের। “টালিগঞ্জ ক্লাবে একটা টুর্নামেন্ট জিতেছিলাম গত বছর। কলকাতায় জেতা আমার একমাত্র টুর্নামেন্ট!”

গল্ফ কেন?
ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে গল্ফ কোর্সে যেত দশ-এগারো বছরের যে কিশোর, তার ভাবনায় কিন্তু গল্ফ ছিল না। তার ধ্যানজ্ঞান বলতে ছিল ক্রিকেট। “প্রথম প্রথম গল্ফ খেলাটা বুঝতামও না। তখন টিম স্পোর্ট অনেক বেশি ভাল লাগত।” তা হলে শেষমেশ ক্রিকেট ব্যাটের বদলে হাতে গল্ফ ক্লাব তুলে নিলেন যে? “উনিশ বছর বয়সে আমি গল্ফের প্রেমে পড়ে যাই। এখন এটাই আমার সাধনা। বলতে পারেন আমার ধ্যান করার একটা রাস্তা।”

গল্ফ কি বড়লোকের শখ?
ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো ঘাম-ঝরানো নয় বলেই হয়তো গল্ফকে ঠিক ‘খেলা’ হিসেবে দেখতে শেখেনি সাধারণ বাঙালি। বা ভারতীয়ও। “এটা কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক একটা ধারণা। গোটা বিশ্ব এই ধারণাটা ঝেড়ে ফেললেও ভারতে এখনও এটা থেকে গিয়েছে। এখানে এখনও গল্ফ সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে,” বলছেন অনির্বাণ।
তা তো হল, কিন্তু গল্ফ কি বড়লোকের শখ? যেখানে মধ্যবিত্তদের প্রবেশ নিষেধ? “তা কেন হবে? আমার কথাই ধরুন না। আমার মতো অনেকেই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে গল্ফকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। আসলে বড়লোকের শখ ব্যাপারটা মনে হয় কারণ টিভিতে গল্ফের যেটুকু দেখা যায়, তাতে মনে হয় এটা বুঝি খুব আরামের খেলা। আদতে তা একেবারেই নয়।
অনেকগুলো অদৃশ্য ফ্যাক্টরও কাজ করে। বছরের অর্ধেক সময়েরও বেশি বিশ্বের এক কোণ থেকে আর এক কোণে ট্র্যাভেল করা, বৃষ্টি, ঠান্ডা... আর শারীরিক চাপ তো আছেই।” কী রকম? অনির্বাণ বলেন, “গল্ফারদের বিশাল-বিশাল বাইসেপ্স বা সিক্স-প্যাক নেই বলে ভাববেন না এটা খুব সুখী খেলা। জিমে প্রচুর ঘাম ঝরাতে হয়। স্ট্রেংথ ট্রেনিং বলতে যা বোঝায়। তা ছাড়া যোগব্যায়াম, ধ্যান সব মিলিয়ে নিজের শরীর-মনের উপরে কড়া নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয় আমাদের।”

অনির্বাণের জীবনে একটা দিন
ধরে নেওয়া যাক একটা গল্ফ টুর্নামেন্ট চলছে। তখন কী ভাবে কাটে তাঁর চব্বিশ ঘণ্টা? “আমি ব্যাক-ক্যালকুলেট করে সব কিছু করি। ধরুন টি-অফ সকাল আটটায়। তা হলে ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠি। হাল্কা স্ট্রেংথ এক্সারসাইজ, একটু যোগব্যায়ামের পরে ব্রেকফাস্ট। কোর্সে গিয়ে নিজের জিনিসপত্র গোছগাছ করা। ওয়ার্ম আপ। আটটায় খেলা শুরু হলে চলে দুপুর একটা পর্যন্ত। এর পরে লাঞ্চ আর ঘণ্টাখানেক প্র্যাক্টিস। হোটেলে ফিরে মিনিট পঁয়তাল্লিশ জিম। হাল্কা ডিনার করে আর্লি টু বেড। টুর্নামেন্টের মধ্যে থাকলে আমি সাত-আট ঘণ্টার বেশি ঘুমোই না। বেশি ঘুমোলে চনমনে ভাবটা চলে যায়।”
কোনও ক্রিকেটার বা ফুটবলারের চেয়ে কোন অংশে কম নিংড়োনো বলুন?

ক্রিকেট না ফুটবল?
ফুটবল মাঠে কোনও দিনই বিশেষ আগ্রহ ছিল না অনির্বাণের। অনেক বেশি করে তাঁকে টানত ক্রিকেটের বাইশ গজ। এখন অবশ্য ভালবাসায় টান পড়েছে। “বড্ড ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে ক্রিকেটের! তবে এখনও সময় পেলে অল্পস্বল্প ক্রিকেট দেখতে ভালই লাগে।” ইডেনে খেলা দেখেছেন? “ওই একটা জিনিস গত দশ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। সময়ই হয় না। আসলে এত ঘুরতে হয়! কিন্তু আমার ভীষণ ইচ্ছে ইডেনে বসে একবার অন্তত ম্যাচ দেখার।” প্রচারের আঁধারে মিডিয়ার হুড়োহুড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে অনির্বাণ এখনও খানিকটা অচেনা মুখ। আর মজার ব্যাপার, সেটাকে উপভোগ করেন তিনি! কেন? “কলকাতায় যে বছরে সপ্তাহ দুয়েকের বেশি আসতে পারি না, সেটা এক দিক থেকে খুব ভাল। এ রকম প্রচারের আলোয় সারাক্ষণ থাকতে হয় না। সৌরভের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না? ওর মতো ২৪X৭ মিডিয়া হাইপে থাকলে সত্যি বলছি, আমি জাস্ট পাগল হয়ে যেতাম!”

কোর্সের বাইরে
অনির্বাণের রিল্যাক্স মোড অন মানে আইপডে হাউজ বা ইলেকট্রনিক মিউজিক। বা ল্যাপটপে সিনেমা। না হলে ফেসবুক-টুইটার খুলে পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে অনলাইন চ্যাট। স্পোর্টস মুভি-র পোকা অনির্বাণ। পছন্দের তালিকায় অ্যাকশন, সায়েন্স ফিকশনও। কী কী সিনেমা কোনও দিন দেখবেন না? “মেয়েলি রোম্যান্স, আর ভূতের সিনেমা!” বেঙ্গালুরুতে থাকলে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা হলেও যান। “তবে এখন আর সময় পাই কই?”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.