চাষিদের থেকে ফসল কেনার টাকার একটা বড় অংশ ফড়ে-পাইকার ও কিছু অসাধু অফিসারের পকেটে যায়, অভিযোগ ছিল দীর্ঘ দিন। এ বার কোটি টাকার ‘আলু কেলেঙ্কারি’ সেটাকেই প্রকাশ্যে নিয়ে এল। ২০১০ সালের এই ঘটনায় দুর্নীতির দায়ে সম্প্রতি ১৩ জনের নামে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেছে রাজ্য সরকার। এর মধ্যে শুধু আরামবাগের এক কৃষি সমবায়ের কর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। বাকিরা ‘পলাতক’। বাকিদের খোঁজ চলছে, জানিয়েছে পুলিশ।
চাষিরা যাতে অভাবের তাড়নায় জলের দরে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য না হন, তার জন্যই সহায়ক মূল্যে চাল বা আলুর মতো অত্যাবশ্যক পণ্য কেনে সরকার। উদ্দেশ্য, ফড়ে-পাইকারদের এড়িয়ে সরাসরি চাষির হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়া। ২০১০ সালে রাজ্যে আলুর উৎপাদন বেশি হওয়ায় অভাবী বিক্রি আটকাতে চাষিদের থেকে সহায়ক মূল্যে আলু কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তদানীন্তন বাম সরকার। রাজ্য কৃষি বিপণন দফতরের মাধ্যমে সরকারি সংস্থা বেনফেড, কনফেড ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিগমকে দেওয়া হয় ৪০০ কোটি টাকা। ঠিক হয়, তারা প্রধান দুই আলু উৎপাদক জেলা, হুগলি ও বর্ধমানে চাষিদের থেকে সরাসরি আলু কিনবে। বিভিন্ন কৃষি সমবায় সমিতির মাধ্যমে তা কেনা হবে।
চারশো কোটি টাকার সেই আলু বিভিন্ন হিমঘরে ঢোকার পরেই কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠতে থাকে ১) প্রকৃত চাষির থেকে নয়, এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর থেকে বেশি দামে নিম্নমানের আলু কেনা হয়েছে। ২) সব আলু হিমঘরে না রেখে কম দামে কিছু বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ৩) কৃষি বিপণন দফতরের কিছু আমলা ও বামফ্রন্টের কিছু নেতা এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত। আরামবাগের প্রাক্তন সিপিএম নেতা জগন্নাথ শাসমল নিজে প্রশাসনের কাছে তিনটি কৃষি সমবায়ের নামে অভিযোগ জানান। |
গোড়ায় পাত্তা না দিলেও পরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রথমে সচিব সুব্রত গুপ্তকে দিয়ে তদন্ত করান। তাতে গরমিল ধরা পড়ায় কৃষি বিপণন দফতরের অধিকর্তা তৃষাণপতি বিশ্বাসের নেতৃত্বে পাঁচ সরকারি অফিসার তদন্ত করেন। প্রাথমিক ভাবে জানা যায়, প্রকৃত চাষির বদলে ভুয়ো চাষিদের নামে আলু কেনা হয়েছে। তছরুপ বেশি হয়েছে হুগলির আরামবাগে।
বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে নিজেদের খাসতালুকে এই কেলেঙ্কারির কথা জেনেও রাজনৈতিক কারণে চেপে গিয়েছিলেন সিপিএমের মন্ত্রীরা। সরকার পরিবর্তনে পরে নতুন কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় ফাইল হাতে পেয়ে ব্যবস্থা নিতে গেলে স্বার্থান্বেষী মহল থেকে পাল্টা চাপ আসতে থাকে বলে অভিযোগ। ফাইল পাঠানো হয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তিনি সিআইডি-কে বিশদ তদন্তের নির্দেশ দেন। তাদের রিপোর্টও আগের প্রশাসনিক রিপোর্টের সঙ্গে মিলে যায়।
এর পরেই কৃষি বিপণন দফতরকে পুলিশে অভিযোগ জানানোর নির্দেশ দেন মমতা। গত ১৭ অক্টোবর দফতরের সহ-অধিকর্তা সুদীপ পাল আরামবাগ থানায় ১৩ জনের নামে লিখিত অভিযোগ (এফআইআর নম্বর ৭৩৩/১২) করেন। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিগমের পারচেজ অফিসার গোরাচাঁদ মুখোপাধ্যায় ছাড়াও তাতে আরামবাগ, বাচানুরি, কাবলে ও প্রতাপনগর কৃষি সমবায়ের কর্তাদের নাম রয়েছে। এর মধ্যে প্রতাপনগর সমবায়ের অন্যতম ডিরেক্টর সনৎ পান ছাড়া কেউ গ্রেফতার হননি।
প্রশাসন সূত্রের খবর, মোট ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা তছরুপ হয়েছিল। প্রশাসন ‘মাস্টার রোল’ থেকে ভুয়ো নাম সরানোর নির্দেশ দিলেও ‘সংশোধিত’ দ্বিতীয় তালিকাতেও কারচুপি ধরা পড়ে। এর ফলে যে প্রকৃত চাষিরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু দেখা যায়, প্রকৃত চাষিরা মাত্র ১৫ লক্ষ টাকা পেয়েছেন। বাকি টাকার হিসেব পুরোটাই কাগজে-কলমে। বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, বাকি অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। |