বছর দেড়েক আগে বারাসতে দিদির শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে খুন হয়েছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব দাস। তার পর বছর না-ঘুরতেই বিশরপাড়ায় ভাগ্নির সম্মান বাঁচাতে গিয়ে মদ্যপ দুষ্কৃতীদের হাতে নিহত হন কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল অসিত দাম। ওই দু’টি ঘটনা সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্যে ইভ-টিজারদের দৌরাত্ম্যের সব চেয়ে মারাত্মক উদাহরণ। কলকাতা পুলিশ এখন গড়ে প্রতি মাসে ৪০-৪৫টি ইভ-টিজিংয়ের অভিযোগ পায়। ইভ-টিজিংয়ের শিকার যাঁরা হন, তাঁদের সাংবিধানিক অধিকারই খর্ব হয় বলে মন্তব্য করে শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট সব ক’টি রাজ্য ও কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চলকে অবিলম্বে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ এখনই মান্য করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দিহান রাজ্যের পুলিশ মহল। প্রধান প্রতিবন্ধকতা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক মহিলা পুলিশের অভাব। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে বাস স্টপ, বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, মেট্রো স্টেশন, সিনেমা ও থিয়েটার, শপিং মল, পার্ক, সমুদ্র সৈকত, যানবাহন, ধর্মস্থান ইত্যাদি জায়গায় সাদা পোশাকের মহিলা পুলিশ অফিসার মোতায়েন করতে হবে। অথচ এই মুহূর্তে কলকাতা পুলিশের সংখ্যা যেখানে প্রায় ২৭ হাজার, সেখানে মহিলা পুলিশ সব মিলিয়ে রয়েছেন ৫০০-রও কম। পুলিশের বক্তব্য, উৎসবের সময় বা নির্দিষ্ট এলাকা থেকে অভিযোগ এলে বিশেষ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু বছর ভর শহর জুড়ে মহিলা পুলিশ মোতায়েন রাখা যে এখনই সম্ভব নয়, তা কার্যত মেনে নিয়েছেন কর্তারা।
কলকাতার যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম বলেন, “কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কয়েক বছর আগেই বাহিনীতে আরও প্রায় তিন হাজার মহিলা পুলিশ নিয়োগের অনুমোদন চেয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। অতি সম্প্রতি রাজ্য সরকার ওই নিয়োগ অনুমোদন করেছে। তাঁদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ সব মিলিয়ে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। তার পরেই তাঁরা কাজ শুরু করবেন।” তবে শামিম জানান, রোমিওদের ধরার জন্য মহিলা পুলিশ দিয়ে রবীন্দ্র সরোবর, পার্ক স্ট্রিটের মতো এলাকায় প্রায়শই ফাঁদ পাতা হয় এবং তাতে সাফল্যও মেলে। লালবাজার সূত্রের খবর, বছর কয়েক আগে হেয়ার স্ট্রিট থানার তৎকালীন অতিরিক্ত ওসি দেবশ্রী চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সাদা পোশাকের পুলিশেরা ধর্মতলা এলাকায় ইভ-টিজারদের দৌরাত্ম্য কমাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কলকাতা পুলিশের চেয়েও করুণ অবস্থা রাজ্য পুলিশের। সিআইডি-র ডিআইজি (স্পেশ্যাল) শঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, “নিয়মিত সাদা পোশাকের মহিলা পুলিশ মোতায়েন করার মতো যথেষ্ট সংখ্যক মহিলা পুলিশকর্মী আমাদের হাতে নেই। সম্প্রতি রাজ্য পুলিশে নতুন ৫০০০ মহিলা পুলিশ নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁরা এখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।”
তবে সুপ্রিম কোর্টের আর একটি নির্দেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে কলকাতা পুলিশ অবশ্য এগিয়ে আছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ও টিভি বসালে এই ধরনের অপরাধ কমানো যাবে বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এখানে কলকাতা পরিকাঠামোয় অনেকটা এগিয়ে আছে রাজ্যের বাকি অংশের চেয়ে। আগামী তিন মাসের মধ্যে শহর ও শহরতলিতে মহিলাদের জন্য বিশেষ হেল্পলাইন চালু করার নির্দেশও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কলকাতা পুলিশ মাস দেড়েক আগেই চালু করে দিয়েছে ‘আস্ক হেল্পলাইন’, যার নম্বর ৮০১৭১০০১০০। কোনও বিপন্ন মহিলা ওই নম্বরে ফোন বা এসএমএস করে তাঁর অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারেন। এর ফলে তাঁর পরিচয়ের গোপনীয়তাও রক্ষা হয়, থানায় সশরীরে যাওয়ার ঝক্কিও পোহাতে হয় না। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষের বক্তব্য, “ইদানীং ওই হেল্পলাইন চালু হওয়ার পর মহিলারা ইভ-টিজিংয়ের মতো অপরাধের অভিযোগ জানাতে বেশি করে এগিয়ে আসছেন। আমাদের ১০৯১ হেল্পলাইনেও ওই ধরনের অভিযোগ জানানো যায়।” সিআইডি-র ডিআইজি (স্পেশ্যাল) শঙ্কর বাবু অবশ্য বলেন, “মহিলাদের জন্য বিশেষ হেল্পলাইন আমরা এখনও চালু করিনি। ভবিষ্যতেও এমন কোনও পরিকল্পনা আছে বলে জানা নেই।” |